বর্তমান ইন্টারনেটের এই যুগে ‘ওয়েব ডেভেলপার’ শব্দযুগল এর সাথে পরিচিত নন, এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে।কারন ইন্টারনেটে আমরা যে ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করি, অনলাইনে কেনাকাটা করি, বই বা অনলাইন পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পড়ি-এসব কিছুই সম্ভব হয় ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে। একজন ওয়েব ডেভেলপার একটি ওয়েবসাইট এর নির্মাণ পরিকল্পনা, ওয়েবসাইট এর কাঠামো নির্মাণ এবং এর রূপদানের কাজটি করে থাকেন।
কিভাবে একজন ওয়েব ডেভেলপার হবেন?
ওয়েব ডেভেলপার হওয়ার জন্য শুধু প্রয়োজন মনোযোগ এবং সময় নিয়ে হাতে কলমে কাজটি ভালোভাবে শেখা। এখানে ওয়েব ডেভেলপার হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা, সফটওয়্যার এবং কিছু প্রয়োজনীয় টুলস সম্পর্কে ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলঃ
প্রথমতঃ একটি সাইটে দুটো দিক থাকে: ডিজাইন বা পরিকল্পনা এবং ডেভেলপমেন্ট। ওয়েব ডেভেলপার এর কর্মদক্ষতা এবং বিশেষত্বভেদে সাধারণতঃ তিন ধরণের ওয়েব ডেভেলপার পাওয়া যায়।
১/ ফ্রন্ট-এন্ড ডেভেলপার
ফ্রন্ট-এন্ড ডেভেলপাররা মূলত ফটোশপ , ইলাস্ট্রেটর, স্কেচ অ্যাপ ব্যাবহার করার মাধ্যমে ওয়েবসাইট ডিজাইন করে থাকেন এবং সেই ডিজাইনকে তারা স্ট্যাটিক HTML, CSS এবং JavaScript কোডে রূপান্তর করে। উদাহরণস্বরূপ যেকোনো একটা ওয়েবপেজের কন্টেন্ট বা ইমেজ পরিবর্তন করতে চাইলে ওই পেজের কোডিং এ গিয়ে এই কন্টেন্টগুলা পরিবর্তন করা যাবে।ওয়েবপেজের ডিজাইন থেকে শুরু করে একে কোডিং-এ কনভার্ট করাটাই হচ্ছে ফ্রন্ট এন্ড ডেভলপারদের কাজ ।
২/ ব্যাক-এন্ড ডেভেলপার
ব্যাক-এন্ড ডেভেলপারদের অবশ্যই ফ্রন্ট-এন্ড ডেভলপিং এর সম্বন্ধে ধারণা থাকা জরুরি । কিন্তু ব্যাক-এন্ড ডেভেলপাররা সাধারণত ডিজাইনের কাজটি করেননা ।তারা ফ্রন্ট-এন্ড ডেভলপারের কাছ থেকে স্ট্যাটিক কোডগুলো নিয়ে সেটাকে ডাইনামিক করেন; অর্থাৎ তারা একটি ওয়ার্কিং বা সচল ওয়েবসাইট, সহজভাষায় অ্যাপসে পরিণত করেন। এক্ষেত্রে একটি এডমিন প্যানেল থাকে যেখান থেকে ওয়েবসাইটের যাবতীয় কন্টেন্ট পরিবর্তন বা নতুন কোন কন্টেন্ট সংযুক্ত করা যায় ।সুতরাং, ব্যাক-এন্ড ডেভেলপারের কাজ হচ্ছে ফ্রন্ট-এন্ড ডেভলপারের স্ট্যাটিক ওয়েব পেইজটিকে পুরোপুরি ডায়নামিক বা ফাংশনাল করে ফেলা ।
৩/ ফুল স্ট্যাক ডেভেলপার
ফুল স্ট্যাক ডেভেলপিংকে ফ্রন্ট-এন্ড ডেভেলপিং এবং ব্যাক-এন্ড ডেভেলপিং এর সমন্বয় বলা যায়। কারণ ফুল স্ট্যাক ডেভেলপাররা ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করে থাকেন। অর্থাৎ একটি ওয়েবসাইট বা অ্যাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়ে তাদের জ্ঞান থাকে এবং সেজন্য তারা নিজেদের ওয়েবসাইট সংক্রান্ত পুরোপুরি কাজ নিজেরাই করতে পারেন।
জেনে নেওয়া যাক যে ধাপগুলো অনুসরণ করে মাধ্যমে আপনি ওয়েব ডেভেলপার হতে পারবেনঃ
এইচটিএমএল(HTML)
এটি একটি মার্ক আপ ল্যাঙ্গুয়েজ যার মাধ্যমে ওয়েবপেজ এর বিভিন্ন অংশকে মার্ক করা হয়। যেমনঃ ওয়েবসাইটের কোথায় হেডার সেকশন থাকবে, কোথায় সাইডবার থাকবে বা কোথায় ফুটার সেকশন থাকবে- এইচটিএমএল এর মাধ্যমে আপনি এগুলো মার্ক করতে পারবেন।অর্থাৎ কোথায় কোন অংশ প্রদর্শিত হবে, এই প্রোগ্রামিং ভাষার মাধ্যমে আপনি সেটা নির্ধারণ করতে পারবেন।
সিএসএস(CSS)
এই ভাষা দ্বারা এইচটিএমএলের ভাষা দিয়ে মার্ক করে রাখা ভাগগুলো ডিজাইন করতে পারবেন যেন ওয়েবপেজটি দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় মনে হয়।যেমন ইমেজের ধরণ কেমন হবে, ব্যাকগ্রাউন্ড কালার কেমন হবে বা কন্টেন্টের ফন্ট সাইজ কত হবে- সিএসএস ভাষা ব্যবহার করে এই কাজগুলো করা যাবে।
জাভাস্ক্রিপ্ট(JavaScript) ও জে কুয়েরি(J Query)
জাভাস্ক্রিপ্ট ও জে কুয়েরি দিয়ে একটা ওয়েবসাইটকে ইন্টার্যাকটিভ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা ফেসবুক বা ইউটিউবের দিকে তাকালে দেখতে পারি যে আমাদের লাইক করা কোন পেজ বা সাবস্ক্রাইব করা কোন চ্যানেলে নতুন কন্টেন্ট আপলোড করা হলে আমাদের নোটিফিকেশন চলে আসে।এটা ইন্টার্যাকটিভিটির একটা উদাহরণ। আপনি আপনার ওয়েবসাইটে স্লাইড শো যুক্ত করে আপনার সাইটটিকে ইন্টার্যাকটিভ করতে পারেন।এরকম যেকোন ধরণের ইন্টার্যাকটিভিটি যুক্ত করার জন্য এই প্রোগ্রামিং ভাষা শিখতে হবে ।
রেস্পন্সিভ ডিজাইন (Responsive Design)
এরপরে যে বিষয়টি শিখবেন সেটি হচ্ছে রেস্পন্সিভ ডিজাইন।কারণ ভিজিটররা বিভিন্ন মাধ্যম যেমন ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট– এ ধরণের বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে ওয়েবসাইট ভিজিট করে থাকেন।ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট গুলা যেন সব মাধ্যমেই সুন্দরভাবে দেখা যায়, সেজন্য ওয়েবসাইটটি রেস্পন্সিভ করতে হয়।
বুটস্ট্রাপ (Bootstrap)
এরপর আপনাকে শিখতে হবে বুটস্ট্রাপ। এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ফ্রেমওয়ার্ক।অধিকাংশ কোম্পানীগুলো তাদের প্রজেক্টের জন্য এই ফ্রেমওয়ার্কটি ব্যবহার করার সুপারিশ করে থাকে । এজন্য এটি শেখা গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু উপরের চারটি প্রোগ্রামিং ভাষা শিখে ফেললে এই ফ্রেমওয়ার্কটি শেখা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
সার্ভার সাইড স্ক্রিপ্ট ল্যাঙ্গুয়েজ
উপরে উল্লেখিত প্রোগ্রামিং ভাষা গুলো শেখা হয়ে গেলে সার্ভার সাইড স্ক্রিপ্ট ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে ফেলতে হবে যেন আপনার ডিজাইন করা অ্যাপটি বা ওয়েবসাইটটিকে আপনি ডাইনামিক বা ফাংশনাল করতে পারেন।এর মাধ্যমে ইউজার কম্পিউটার থেকে নিয়ন্ত্রণের বদলে সার্ভার থেকে অনেকগুলো কাজ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। অনেকগুলো সার্ভার সাইড স্ক্রিপ্ট ল্যাঙ্গুয়েজ আছে । যেমন পিএইচপি(PHP), রুবি(Ruby), পাইথন (Python), এসএমএক্স(SMX), নোড জেএস(Node JS)-আপনি যেকোন একটা শিখে নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন।
ওয়ার্ডপ্রেস (WordPress) ও লারাভেল (Laravel)
যেকোনো একটি সার্ভার সাইড স্ক্রিপ্ট ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে ফেলার পর ওয়ার্ডপ্রেস (WordPress) বা লারাভেল (Laravel) যেকোনো সফটওয়্যার এর কাজ শিখে নিতে হবে।তবে এক্ষেত্রে ওয়ার্ডপ্রেস রয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কারণ পুরো অনলাইন জগতে যতগুলো ওয়েবসাইট আছে তার ৩৫% থেকে ৪০% ওয়েবসাইট ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে অপারেট করা হচ্ছে।আবার যতগুলো ই-কমার্স ওয়েবসাইট আছে তার মধ্যে প্রায় ৬০% উ-কমার্স(WooCommerce) দিয়ে চালনা করা হচ্ছে, যেটা ওয়ার্ডপ্রেসেরই একটি প্লাগ-ইন।
গিট (GIT)
গিট হলো একটি ভার্সন কন্ট্রোল সিস্টেম। এর মাধ্যমে আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে আপনার টিমের সাথে সংযুক্ত থেকে কাজ করতে পারবেন।তাছাড়া আপনার তৈরি করা ওয়েবসাইটটির ব্যবহারকারীদের স্বচ্ছন্দ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করার জন্য আপনি এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রয়োজনে নতুন কিছু সংযুক্ত করতে পারেন। এমনকি কোন সংযুক্তি পছন্দ না হলে বা অপ্রয়োজনীয় মনে হলে ফাইল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় ছাড়াই ফাইলটির পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন।
ইউআই (UI)/ ইউএক্স (UX)
এর মাধ্যমে ফটোশপ,ইলাস্ট্রেটর বা স্কেচের মত অ্যাপ ব্যাবহার করে ওয়েবসাইটের ডিজাইন করা যায়।
সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (SEO)
এ পর্যায়ে ওয়েবসাইটকে গুগল র্যাংকিং এ নিয়ে আসার জন্য সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা শিখে ফেলা সুবিধাজনক। সাধারণত একটি ওয়েবসাইটকে গুগল র্যাংকিং এ আনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট ।কিন্তু এরপরও কিভাবে ওয়েবসাইট কে কোডিং করা হয়েছে, এ বিষয়ের ওপরও র্যাংকিং অনেকটাই নির্ভর করে। তাই আপনি যদি কোন ক্লায়েন্টের জন্য কোন ওয়েবসাইট তৈরী করেন, তবে সেটি এসইও (SEO) ফ্রেমওয়ার্ক অনুসারে করতে হবে যেন আপনার তৈরি করা ওয়েবসাইটটি গুগল র্যাঙ্কিং এ উপরের দিকে প্রদর্শিত হয়।
ফটোশপ (Photoshop)
ফটোশপ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকতে হবে যেমন ইমেজ থেকে কিভাবে কোন অংশকে কাট বা ক্রপ করে নিতে হয়, এ ব্যাপারে ধারণা থাকতে হবে।ডিজাইনাররা ডিজাইন সাবমিট করলে আপনি যাতে বিভিন্ন উপাদানগুলোকে আলাদা করে নিতে পারেন এবং সফটওয়্যার যুক্ত করতে পারেন, এজন্য ফটোশপ জানা জরুরি।
ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে চাইলে আপনি বিভিন্ন সুবিধা পেতে পারেন যেমন স্বাধীনভাবে আপানার সময় এবং সুবিধা অনুসারে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে পারেন বা সফটওয়্যার কোম্পানি বা টেকনোলজি কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ পেতে পারেন। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন কারণ প্রত্যেকটি কোম্পানিরই ওয়েবসাইটের প্রয়োজন আছে, তাই অনলাইনে ওয়েব ডেভেলপারদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।অর্থাৎ শেখার সুযোগ অবারিত আর সুবিধাও অনেক। তাই আপনি উপরের ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে অনুসরণ করে এখন থেকেই ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে নিজেকে গড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিতে পারেন।