চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী সাফল্য ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ইতিকথা

হ্যালো টিউডার বন্ধুরা, কেমন আছেন সবাই? আশা করি ভালোই আছেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখেন। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। কারন করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। দেশে আবার লকডাউন পড়েছে। তাই ঘরে বসে সব কাজের পাশাপাশি দু একটা টিউন পড়ে নিন। বরাবরের মতো আজো নিয়ে এসেছি একটি টিউন। অল্প কিছু সময় চোখ বুলিয়ে নিন আমার টিউনটিতে। আশাকরি আপনি সন্তুষ্ট হবেন।

ভ্যাকসিন বা টিকা কীঃ

যে জৈব রাসায়নিক মিশ্রণ দেহে Antibody তৈরি করে Immunity বা রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে তাকে Vaccine বা টিকা বলে। ল্যাটিন শব্দ Vacca থেকে Vaccine শব্দটির উৎপত্তি হয়। ল্যাটিন ভাষায় Vacca শব্দটির অর্থ হচ্ছে Cow (গরু)। টিকা মানুষের দেহকে নির্দিষ্ট কোনাে একটি সংক্রমণ, ভাইরাস কিংবা রােগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত করে।

ভ্যাকসিন বা টিকা কী

যেভাবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারঃ

ভ্যাকসিন চিকিৎসা দুনিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে ধরা হয়। টিকার ধারণা তৈরি হয় চীনে। দশম শতাব্দীর শুরুতে চীনার ভ্যাকসিনেশনের আদিরূপ ভ্যারিওলেশন নামক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করে। এ প্রক্রিয়ায় গুটি বসন্তে (Smallpox) আক্রান্তদের দেহের পাঁচড়া (Scab) হতে টিস্যু নিয়ে সুস্থ মানুষদেরকে এটির সংস্পর্শে আনা হতাে।

তবে এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়নি। ধীরে ধীরে তুরস্ক ও ইংল্যান্ডে ভ্যারিওলেশন বিস্তার লাভ করে। আট শতাব্দী পরে ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার গুটি বসন্তে অসংখ্য মানুষ মারা যাওয়া দেখে টিকা আবিষ্কারের বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ১৭৯৬ সালে সারা নেলমস নামের এক তরুণ গােয়ালিনীর দেহের গােবসন্তের তাজা ক্ষত থেকে টিকার উপাদান সংগ্রহ করেন এডওয়ার্ড জেনার।

এ উপাদান দিয়ে তৈরি টিকা ১৪ মে ১৭৯৬ সর্বপ্রথম জেমস ফিপস নামের আট বছর বয়সী শিশুর গায়ে পুস করেন। ১ জুলাই ১৭৯৬ দ্বিতীয় ধাপে টিকা দেন এডওয়ার্ড। রােগ ভাল হয়ে যাওয়ার পর তিনি ছেলেটির দেহে গুটিবসন্তের জীবাণু প্রবেশ করান।

১৭৯৮ সালে এডওয়ার্ড জেনারের গবেষণা পত্র প্রকাশ হওয়ার পর তা ব্যাপক গ্রহণযােগ্যতা পায়। ফলে বিশ্ব প্রথম ভ্যাকসিন বা টিকা শব্দটার সাথে পরিচিত হয়। এডওয়ার্ড জেনার গুটি বসন্তের টিকার আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তাই পরবর্তীতে এডওয়ার্ড জেনারকে ভ্যাকসিনের জনক বলা হয়।

পরবর্তীকালে রুবেলা ও মাম্পস এর টিকা আবিষ্কার করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী মরিস হিলেম্যান। তাই তাকে আধুনিক ভ্যাকসিনের জনক বলা হয়।

Maurice Hilleman

Maurice Hilleman Source is Wikipedia is licenced under CC BY-SA 3.0

লুইপাস্তুর জলাতঙ্কের (Rabies) টিকা আবিষ্কার করেন এবং ভ্যাকসিন জগতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন।

ভ্যাকসিনের মাধ্যমে নির্মূল রােগঃ

যে কোনাে সংক্রামক রােগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিন বা টিকার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু গেল দুই শতাব্দীতে পৃথিবী থেকে টিকার মাধ্যমে মাত্র দুটি রোগ নির্মূল হয়েছে। একটি হলাে Smallpox বাংলায় যাকে বলে গুটি বসন্ত। আর অন্যটি Rinderpest যা মূলত গবাদিপশুর রােগ। এটি গরুর বসন্ত নামেও পরিচিত। ১৯৬৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ১৯ তম সম্মেলনে তৎকালীন মহাপরিচালককে গুটি বসন্ত নির্মূলের জন্য কর্মসূচি গ্রহণের অনুরােধ করা হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় ৯ ডিসেম্বর ১৯৭৯ Global Commission for the Certification of Smallpox Eradication কর্মসূচির মাধ্যমে WHO বিশ্বকে গুটি বসন্ত মুক্ত ঘােষণা করেন। ৮ মে ১৯৮০ WHO এর সম্মেলনে এটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। আর Rinderpest নির্মুলের ঘোষণা দেওয়া হয় ২৮ এ জুন ২০১১ সালে।

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রোগের টিকার আবিস্কারকঃ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO এর তথ্য অনুযায়ী  ২৭ টি রোগের ভ্যাকসিন রয়েছে বা এ রোগের প্রতিরোধ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সম্ভব। এতগুলো রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু রোগের ভ্যাকসিন এর আবিস্কারক সম্পর্কে বলবো।

হেপাটাইটিস বি এমন একটি রোগ যার আক্রমণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণে হয়। বড়দের ক্ষেত্রে অল্প সময়ে সারিয়ে যায় কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে সহজে সারায় না। এ রোগ যকৃতে সংক্রমণ ঘটায়। এর সংক্রমণ ছড়ায় শরীরের কোন তরল পদার্থ, রক্ত বা বীর্যের মাধ্যমে। এর টিকার আবিস্কারক যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ।

Baruch Samuel Blumberg

Baruch Samuel Blumberg Source is Wikipedia is licenced under CC BY-SA 3.0

কলেরা একটি সংক্রামক রোগ যা Vibrio Cholerae নামক একটি ব্যাকটেরিয়া এর সংক্রমণে হয়ে থাকে। ফলে রোগীর ঘন ঘন চাল ধোয়া পানির মতো পাতলা পায়খানা হয়। শেষ পর্যন্ত রোগী পানিশুন্যতায় মারা যায়। এটি একটি মহামারী।

জলাতঙ্ক এমন একটি রোগ যা পশু প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়। তাই এ রোগটিকে জুনোটিক রোগ বলে। জলাতঙ্ক Rabies ভাইরাসের কারনে হয় যা কুকুরের কামড় বা আচরে হয়ে থাকে। অন্যান্য প্রানীর কারণেও হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্স একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ কয়লা। এটি একটা তীব্র সংক্রামক রোগ যা সধারনত পশু প্রাণীদের হয়ে থাকে। Bacillus anthracis নামক জীবানুর কারণে এটি হয়। আক্রান্ত পশুর মাংস খেলে মানুষের ও হতে পারে। এটি শরীরে বিভিন্ন ক্ষত সৃষ্টি করে। এই তিনটি রোগের ভ্যাকসিন আবিস্কার করেন ফ্রান্সের বিজ্ঞানী লুই পাস্তর।

রুবেলা একটি ভাইরাস সংক্রমিত রোগ যা রুবেলা ভাইরাসের কারনে হয়ে থাকে। রুবেলা একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ সামান্য লাল। এর সংক্রমনের ফলে শরীরে হালকা লালচে রঙের ফুসকুড়ি সৃষ্টি হয়। এই রোগটি জার্মান হাম নামেও পরিচিত। এর ভ্যাকসিন আবিস্কারক মরিস হিলেম্যান। মাম্পস একটি ভাইরাস সংক্রামিত রোগ যা মাম্পস ভাইরাসের কারনে হয়ে থাকে। এটি মাম্পস প্যারাটাইটাস নামেও পরিচিত। এর ভ্যাকসিনের আবিষ্কারকের নামও মরিস হিলেম্যান।

যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ যা সধারনত ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটায়। তবে এটা শরীরের অন্য অংশেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এটা Microbacterium tuberculosis নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়। এর ভ্যাকসিন আবিস্কার করেন আলবার্ট ক্যালমিটি ও ক্যামিলি গিওরিন যারা ফ্রান্সের বাসিন্দা।

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু কথাঃ

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা Sputnik – V  যা রাশিয়ার তৈরি এবং এর পরীক্ষার পর কার্যকরীতা ৯১.৬%। তবে করোনার উপসর্গ থাকা ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এ কার্যকারিতা বেরে ৯১.৮% হয়। এই টিকা প্রস্তুত কারী প্রতিষ্ঠানের নাম দি গামালিয়া ন্যাশনাল সেন্টার, রাশিয়া ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।  ২১ দিনের ব্যাবধানে এ টিকার দুটি ডোজ নিতে হবে।

করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন

অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকশিনের নাম কোভিশিল্ড যা বাংলাদেশে করোনা প্রতিরোধে দেওয়া হচ্ছে। এটির দুটি ডোজ নিতে হবে। ১-৩ মাস ব্যাবধানে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। দুই ডোজের মাঝে বিরতি কমের কারনে কার্যকারিতায় দুর্বলতা পাওয়ায় বিরতি ৩ মাস করা হয়েছে। এ টিকার কার্যকরীতা ৬২-৯০% পর্যন্ত কার্যকর। এ টিকা বানিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করছে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট যা বিশ্বের বৃহত্তম টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান।

২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি নোভাভ্যাক্স এবং জনসন এন্ড জনসন তাদের টিকার চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার কার্যকারিতা ঘোষণা করে। নোভাভ্যাক্সের একটি টিকা বড় পরিসরে ৮৯.৩% কার্যকারিতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে জনসন এন্ড জনসন তাদের টিকা বিশ্বজুড়ে নতুন করোণা ভাইরাসের একাধিক ধরনের বিরুদ্ধে ব্যাপক পরীক্ষা করে ৬৬% কার্যকারিতা পায়। যা ছিলো এক ডোজের টিকা। ফাইজার বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকার মতো জনসন এন্ড জনসন টিকার দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োজন হবে না বা পাস্তরায়ন হবে না।

২০২১ সালের ২৭ শে জানুয়ারি বাংলাদেশে টিকা দান কর্মসুচীর উদ্বোধন হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভ্যাকসিন গ্রহন করেণ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা।

তো বন্ধুরা এই ছিলো আমার সামান্যতম আয়োজন। আশাকরি আপনাদের কাছে কিছু জ্ঞান নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। ভালো লাগলে জোসস দিয়ে অনুপ্রেরণা দিবেন। মন্তব্য থাকলে টিউমেন্ট কতে আমকে জানবেন। মনোযোগ সহকারে টিউনটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম।

Add Comment