প্রেজেন্টেশন বা উপস্থাপনার কথা উঠলেই আমাদের মাথায় প্রথমেই আসে মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট সফটওয়্যারটির কথা৷ পাওয়ারপয়েন্ট ছাড়া প্রেজেন্টেশন যেন অকল্পনীয়৷ তবে বর্তমানে প্রেজেন্টেশনকে আরও চমকপ্রদ করতে পাওয়ারপয়েন্টের বাইরেও চিন্তা করার সুযোগ রয়েছে৷
কেননা প্রেজেন্টেশনকে আরও আকর্ষণীয় করতে বর্তমান বাজারে রয়েছে একশোটিরও বেশী সফটওয়্যার৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে এত এত সফটওয়্যারের মাঝে কোন সফটওয়্যারটি বেছে নেবেন৷ সকল সফটওয়্যারেই কিছু সুবিধা অসুবিধা রয়েছে৷ তাই বাছাই করাটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এবং ব্যবহারকারীর ধরণের উপর৷ যেমন, আপনি কোন পেশার অন্তর্ভুক্ত, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, গবেষক নাকি প্রতিবেদক এবং কোন উদ্দেশ্যে আপনি প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে চাইছেন, তার উপর৷ বাছাইয়ের এই সুবিধার্থে প্রয়োজন শুধুমাত্র বিশেষ কিছু প্রেজেন্টেশন প্লাটফর্ম সম্পর্কে জানা যা আমাদের আলোচনার মূল বিষয়৷
প্রেজেন্টেশনে মূলত কোন তথ্যকে সংশ্লিষ্ট ছবি, ভিডিও, গ্রাফ বা চার্ট সংযুক্ত করে উপস্থাপন করা হয় এবং একে স্লাইড শো আকারে প্রদর্শন করা হয়৷ সংক্ষেপে প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারকে তথ্য উপস্থাপনের অ্যাপ্লিকেশনও বলা যায়।
যেকোন প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারের মৌলিক কিছু ফাংশন থাকে। যেমন : টেক্সট এডিটর (উপস্থাপনার বিষয়বস্তু ইনপুট করা হয়), ইম্পোর্ট ফাংশন (তথ্য সন্নিবেশ করা হয়), স্লাইড শো অথবা প্রেজেন্টর মোড(সন্নিবেশিত ডেটাকে ফরম্যাটেড উপায়ে প্রদর্শন করা হয়)।
এখানে পাওয়ারপয়েন্ট ছাড়াও যে প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারগুলো বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
কয়েকটি প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলঃ
স্লাইড বিন ( SlideBean)
স্লাইডবিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অসাধারণ একটি প্রেজেন্টেশন টুল যা আজকের প্রেজেন্টেশন ধারণাকেই বদলে দিয়েছে । কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হওয়ায় এই সফটওয়্যার স্লাইডের প্রতিটি উপাদানের জন্য সম্ভাব্য সবথেকে ভালো ডিজাইনটা শো করে থাকে এবং ফরম্যাটিং এর দুশ্চিন্তা ছাড়াই এর মাধ্যমে দারুন স্লাইড ডিজাইন করা যায়৷
স্লাইডবিনের এই স্বয়ংক্রিয়তা প্রেজেন্টেশনকে প্রোফেশনাল লেভেলে নিয়ে যেতে সাহায্য করে এবং পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের চাইতে তুলনামূলক কম সময়ে কাজ শেষ করা যায়৷ স্লাইডবিনের অনন্য সুবিধাটিই হচ্ছে এর স্বয়ংক্রিয়তা৷ এছাড়া এর আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এর বৈচিত্র্যপূর্ণ টেমপ্লেট সমৃদ্ধ গ্যালারী, যা ক্লাসরুম প্রেজেন্টেশন থেকে শুরু করে থিসিস প্রেজেন্টেশন কিংবা বিজনেস প্রোপোজাল সহ আরো অনেক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
প্রয়োজন শুধু কন্টেন্ট প্রস্তুত করা, টুলে সংযোজন আর টেমপ্লেট অটোমেটিক্যালি কাস্টমাইজড হয়ে যাবে৷ পাওয়ারপয়েন্টের তুলনায় স্লাইডবিন ইন্টারফেস শেখা এবং কাজ করা অনেক সহজ, সাথে সময় সাশ্রয়ীও৷ তবে প্লাটফরমটি ওয়েববেজড অর্থাৎ পুরোপুরি অনলাইন প্লাটফর্ম হওয়ায়, ইন্টারনেট সংযোগের ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
তাছাড়া ওয়েববেজড হওয়ার কারণে কোন ঝামেলা ছাড়াই কাঙ্খিত প্রেজেন্টেশনটি পাওয়ারপয়েন্ট কিংবা পিডিএফ ফরম্যাটে ডাউনলোড করা যায় কিংবা উপস্থাপন করা যায়৷
প্রেজি (Prezi)
বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ নতুন আঙ্গিকের প্রেজেন্টেশন বানাতে ব্যবহার করছেন প্রেজি৷ পাওয়ারপয়েন্টের বাইরে গিয়েও এখন নতুন টুলকে স্বাগতম জানাচ্ছে প্রেজেন্টাররা৷ স্লাইডভিত্তিক প্রেজেন্টেশনের ধারণায় নতুন মাত্রা জুড়ে দিয়েছে প্রেজি৷ নতুন আঙ্গিকের এই প্লাটফর্মটি প্রেজন্টেশনে যুক্ত করেছে ত্রিমাত্রিকতা৷
বিষয়ভিত্তিক থিম আর চমকপ্রদ নকশা সমৃদ্ধ এই প্লাটফর্মটিতে যেকোন বড় বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে৷ সুযোগ রয়েছে জুম ইন এবং জুম আউট করে স্লাইডের প্রতিটি ডিটেইলস নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করার৷ স্লাইডের আঙ্গিকে বানানো হলেও একটি বিভাগের মধ্যে ধাপে ধাপে ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশন ব্যবহারের সুবিধা এই প্লাটফর্মটিকে অনন্যতা প্রদান করেছে৷
অসংখ্য টেমপ্লেট অন্তর্ভুক্ত থাকায় প্রেজেন্টেশনে যারা বিগিনার তাদের জন্য এটি যেমন সুবিধাজনক, তেমনি ডিজাইনিংয়ে দক্ষতা না থাকলে এতে এডিট করা ততটাই অসুবিধাজনক৷ কাঙ্খিত প্রেজেন্টেশনটি অনেকগুলো ডিভাইসে উপস্থাপনার সাথে সাথে সহকর্মীদের সাথেও শেয়ার করা যায়। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সংগঠন কিংবা কীনোট স্পীকারদের জন্য উপযোগী একটি প্লাটফর্ম হলো প্রেজি৷ তাছাড়া এর মাধ্যমে অফলাইনেও প্রেজেন্টেশন তৈরি করার সুযোগ রয়েছে।
ক্যানভা (Canva)
ফটো এডিটর হিসেবে অধিক সুপরিচিত ক্যানভা আসলে একটি অসাধারণ গ্রাফিক ডিজাইন এবং প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার৷ এর সাহায্যে ব্যানার, পোস্টার থেকে শুরু করে অ্যানিমেশন, প্রেজেন্টেশন, ইউটিউব থাম্বনেইল, লোগো, ব্লগ, ফেসবুক থাম্বনেইল, পিন্টারেস্ট গ্রাফিক্স, রিজিউমি পর্যন্ত যেকোন কিছু উপস্থাপন করা যায় খুব সহজে৷
সফটওয়্যারটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। ডিজাইনিংয়ে অদক্ষ হলেও চিন্তার কোন কারণ নেই৷ কারণ এ সফটওয়্যারটিতে হাজার হাজার বিল্ট ইন টেমপ্লেট প্রস্তুত রাখা হয়েছে কাজের সুবিধার্থে। হাজার টেমপ্লেট থেকে পছন্দসই প্রেজেন্টেশন বানানো যাবে। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো প্রয়োজনে এ টেমপ্লেটগুলো পরিবর্তনও করা যাবে।অন্যদের সাথে শেয়ারের পাশাপাশি নিজের ব্লগেও সরাসরি উপস্থাপন করা যায়৷ তবে প্রেজেন্টেশন ফাইলটি পিডিএফ কিংবা জেপিজি ফরম্যাটে ডাউনলোড করা গেলেও পাওয়ারপয়েন্টে কনভার্ট করা যায় না৷
স্লাইড ডগ (Slide Dog)
স্লাইড ডগ এমন একটি উইন্ডোজ অ্যাপ্লিকেশন যা অনলাইনে বিনামূল্যেই পাওয়া যায়৷ জনপ্রিয় এই সফটওয়্যারটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রেজেন্টেশন এর সকল কন্টেন্ট ( ডকুমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ছবি কিংবা ভিডিও) কে প্লে লিস্ট আকারে সাজিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক প্রদর্শন করতে থাকে৷ মাইক্রোসফট, পাওয়ারপয়েন্ট কিংবা এক্সেল থেকে সরাসরি যেকোন ফাইল সংযোজন করা যায় স্লাইড ডগে৷ এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে আলাদা আলাদা মনিটরে ভিন্ন ভিন্ন প্রেজেন্টেশন দেখানো যায়।
কাঙ্খিত প্রেজেন্টেশনটি ভিডিও, ছবি কিংবা পাওয়ারপয়েন্ট ফাইল হিসেবে উপস্থাপন করা যায় এবং বানানোর সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইন প্লাটফর্মে দেখানো যায় বলে এখানে সরাসরি পোলিং (মতামত প্রদান)-ও করা যায়৷ ফাইল ডাউনলোড করে মোবাইলে দেখা যায় এবং বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করা যায় খুব সহজে৷ অনেকগুলো ডকুমেন্টের প্রেজেন্টেশন করার ক্ষেত্রে উপযোগী একটি সফটওয়্যার স্লাইড ডগ৷
গুগল স্লাইডস ( Google Slides)
কয়েকজন বন্ধু যখন ভিন্ন অবস্থানে থেকেও একসাথে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে ফেলতে পারে এর থেকে চমকপ্রদ আর কি হতে পারে! পাওয়ারপয়েন্টের আদলে তৈরী হলেও গুগল স্লাইডস এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি একে আলাদা করেছে পাওয়ারপয়েন্ট থেকে৷ বর্তমানের গ্রুপ স্টাডিংয়ের ধারণায় খুবই কার্যকরী একটি প্লাটফর্ম গুগল স্লাইডস। খুব সহজেই গুগল ড্রাইভ কিংবা গুগল একাউন্টের মাধ্যমে প্রবেশ করেই ধাপে ধাপে প্রেজেন্টেশন তৈরির সম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা যায়৷ অনলাইনে প্রেজেন্টেশন তৈরীর পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে শেয়ারও করা যায়৷ সীমিত ফিচার, ফন্ট কিংবা কাস্টমাইজেশনের সীমিত অপশন থাকলেও অনলাইনে কাজ করার জন্য এটি একটি চমৎকার প্লাটফর্ম। তাছাড়া প্রেজেন্টেশন ফাইলটি ডাউনলোড করে অফলাইনে এডিট করার বা ব্যবহার করার সুবিধাও আছে৷ শিক্ষার্থীদের জন্য এটি সহজলভ্য ও উপযোগী একটি প্লাটফর্ম৷
হাইকু ডেক (Haiku Deck)
এটি মূলত একটি টেমপ্লেটবেজড প্লাটফর্ম যা দিয়ে চমৎকার সব প্রেজেন্টেশন তৈরী করা যায়৷ স্লাইডে ব্যবহারের জন্য ৩৫ মিলিয়নেরও বেশী ছবি এবং ৩৫ ধরনের টেমপ্লেট অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে এই সফটওয়্যারটি৷ এটি ব্যবহারে সহজ হলেও অফলাইনে কাজ করা যায় না। এর টেমপ্লেটকে পছন্দসই কাস্টমাইজও করা যায় না বললেই চলে। তবে এটি যেকোন উপস্থাপনার জন্য উপযোগী। তাছাড়া এর বড় একটি সুবিধা হচ্ছে, অনলাইন হওয়ার কারণে সফটওয়্যারের সার্চ অপশন ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেট থেকে ডেটা সিলেক্ট করা যায় এবং প্রেজেন্টেশনে কপি-পেস্ট করা যায়। তাই এর সাহায্যে দ্রুত প্রেজেন্টেশন তৈরি করা সম্ভব হয়।
স্লাইড শার্ক ( Slide Shark)
স্লাইড শার্ক এমন একটি সফটওয়্যার যার মাধ্যমে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনকে আইফোন বা আইপ্যাডেও প্রেজেন্ট করা যায়। এর সাহায্যে মাত্র তিনটি ধাপ তথা আপলোড- কনভার্ট-ভিউ এর মাধ্যমেই অত্যন্ত সহজে যেকোনো জায়গায় আপনার আইপ্যাড থেকে আপনার পাওারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনটি সকলের সামনে উপস্থাপন করতে পারবেন। ক্লাউড স্টোরেজের সুবিধা থাকায় ফাইল সংরক্ষনও করা যায় খুব সহজে৷ ওয়েবে প্রেজেন্টেশন ব্রডকাস্ট করার মত ফিচার এই প্লাটফর্মটিকে আরো চমকপ্রদ করেছে। প্রেজেন্টেশনকে পছন্দসই কাস্টমাইজ করা না গে
লেও এর একটি সুবিধা এই যে, আপনি এটিকে বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন৷ তবে এর পেইড ভার্সনও রয়েছে যা বিজনেস প্রো (Business pro) হিসেবে পরিচিত৷ এটি সেলস এবং মার্কেটিং প্রফেশনালসদের জন্য উপযোগী একটি প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার।
এছাড়াও অ্যাডোবি স্পার্ক (Adobe Spark), ভিসমে (Visme), ক্লিয়ারস্লাইড (ClearSlide), জোহো শো (Zoho Show), কীনোট (Keynote), কাস্টম শো (Custom Show), পাওটুন- অ্যানিমেশন প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার (Pawtoon- Animation Presentation Software), মিডিয়াশাউট (MediaShout), নলেজ ভিশন (Knowledge Vision) সহ আরও অসংখ্য ভালো ভালো প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার রয়েছে। ভালো প্রেজেন্টেশন বলতে আসলে শুধু সুন্দর কথা, অঙ্গভঙ্গিই বুঝায় না, আকর্ষণীয় স্লাইড তৈরিও এই দক্ষতার বিশেষ অংশ। বর্তমানে প্রচুর প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যারের অপশন আপনি পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু এরই মাঝে আপনার চাহিদা অনুসারে কোনটার ফিচার, কনফিগারেশন আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সুবিধা প্রদান করবে ,সেটিও আপনাকেই নিশ্চিত হতে হবে।