সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাশ হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত ‘চিপস এন্ড সাইন্স এক্ট’ । যদিও এটি আরো আগেই শুরু হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তারপরও ‘বেটার লেট দেন নেভার’ । যেখানে ‘৯০ এর দশকে আমেরিকা তার প্রয়োজনের ৩৭% চিপ নিজ দেশেই তৈরী করত, এখন সেটা ১২% এ নেমে এসেছে । এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বব্যাপী চিপের দুষ্প্রাপ্যতা, জাতীয় নিরাপত্তা এবং চীনের সাথে আন্তর্জাতিকভাবে বৈরিতা । এই ‘চিপস এন্ড সাইন্স এক্ট’ এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে আমেরিকার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনা, কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রযুক্তি নির্ভর কর্মসংস্থান তৈরী করা । এই আইনের আওতায় আগামী পাঁচ বছরে মোট বিনিয়োগ করা হবে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যার মধ্যে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে ‘রিসার্চ এবং ইনোভেশনে’ এবং ২৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে নতুন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে ট্যাক্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিতে । যাই হোক, এই লেখার উদ্দেশ্য নতুন এই আইনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তৈরী হওয়া সুযোগ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষার্থীরা কিভাবে গ্রহণ করতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করা ।
মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ এসব নিত্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক্সের বদৌলতে আমরা সবাই কমবেশি সেমিকন্ডাক্টর চিপ, আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এসব নামের সাথে পরিচিত। এসব ইলেকট্রনিক্স লক্ষ লক্ষ ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট সমন্বয়ে তৈরী হয় এবং এদের সবার বিল্ডিং ব্লক হচ্ছে ট্রানজিস্টর । কিছু কিছু কোম্পানি আছে যারা শুধু ট্রানজিস্টর উৎপাদন করে এবং সেগুলো বিক্রি করে – এদের বলে ফাউন্ডরি, যেমন তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন, ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন, গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ ইত্যাদি। আবার কিছু কোম্পানি আছে যারা ট্রানজিস্টর ফাউন্ডরির কাছ থেকে কিনে নেয় এবং তারপর সেগুলো ব্যবহার করে আইসি ডিজাইন করে, এদেরকে বলা হয় ফ্যাবলেস সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি, যেমন কোয়ালকম, এনভিডিয়া, ব্রডকম ইত্যাদি। যারা দুটো ব্যবসাই করে, তাদেরকে বলে ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারার, যেমন স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স, ইন্টেল কর্পোরেশন, টেক্সাস ইন্স্ট্রুমেন্ট ইত্যাদি । ৯০’ র দশকের শুরুতে এই ফাউন্ডরি ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিল জাপানে, এনইসি কর্পোরেশন, তোশিবা কর্পোরেশন এদের হাতে যা পরে দখল করে নেয় মার্কিন কোম্পানি ইন্টেল, এএমডি (বর্তমানে গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ) । কিন্তু গত এক দশকে এশিয়ান কোম্পানিগুলোর উত্থানে উল্লেখযোগ্য ব্যবসা চলে যায় স্যামসাং (দক্ষিণ কোরিয়া), ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন (তাইওয়ান), তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন (তাইওয়ান), উইন সেমিকন্ডাক্টর (তাইওয়ান), সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (চীন) এদের হাতে । মূলত এখানে দুটি বিষয় আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ । এক, চীনের সাথে বৈরিতা এবং জাতীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে চাইনিজ ফাউন্ডরি থেকে ট্রান্জিস্টর কিনতে মার্কিন কোম্পানিদের নিরুৎসাহিত করা । দুই, তাইওয়ানের সাথে চীনের বৈরিতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো চীন যদি তাইওয়ানকে আক্রমণ করে বসে, তখন চীনের সরবরাহের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না হয়ে যাওয়া ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার ঘোষণায় বলেন যে এই ‘চিপস এন্ড সাইন্স এক্ট’ এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে ফাউন্ডরি ব্যবসার প্রচুর বিনিয়োগ হবে এবং ফলশ্রুতিতে আনুমানিক তিন লক্ষ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইন্টেল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা আমেরিকার ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চিপ প্লান্ট গড়ে তুলবে যেখানে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী হবে । মাইক্রন টেকনোলজি প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে যা প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরী করবে । এছাড়া কোয়ালকম এবং গ্লোবাল ফাউন্ড্রিজ যৌথ পার্টনারশিপের্ মাধ্যমে ৪.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে নিউইয়র্কে তাদের চিপ প্লান্টের সম্প্রসারণের কাজে । একথা সর্বজনবিদীত যে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে পর্যাপ্ত পরিমান দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে যার কারণে আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ অভিবাসীরা এখানে কর্মরত আছি । অদূর ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হলে দক্ষ অভিবাসীদের চাহিদা আরো বাড়বে । তাই যে সমস্ত বাংলাদেশীরা বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তারা যদি এখন থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন, তবে ভবিষ্যতে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে চাকুরী পাওয়া অনেক সহজ হবে । এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ধারণা হলো সেমিকন্ডাক্টর বা ফাউন্ডরিগুলোতে শুধু তড়িৎ প্রকৌশলীদের চাহিদা থাকে যদিও ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য না । এটা ঠিক যে, তড়িৎ প্রকৌশীলের সংখ্যা বেশি থাকে কিন্তু একটি ফাউন্ডরীতে অনেক ধরণের বিশেষজ্ঞর প্রয়োজন হয় । যেমন ধরা যাক, কোয়ালিটি ইঞ্জিনিয়ার বা রিলিয়াবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার পদবীতে গণিত বা পরিসংখ্যান থেকে পাশ করা বহু মানুষ কর্মরত আছেন । আবার প্যাকেজ ইঞ্জিনিয়ার পজিশনে প্রচুর যন্ত্রপ্রকৌশলীরা চাকুরীরত আছেন । এছাড়া প্রচুরসংখ্যক পদার্থবিদতো আছেনই । তাছাড়া ইলেকট্রনিক ভেহিকেলের জন্য ব্যাটারির ওপর প্রচুর কর্মসংস্থানও তৈরী হচ্ছে যেখানে রসায়ন থেকে পাশ করা মানুষদের জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে । আবার এতো নতুন প্লান্ট গড়ে তোলার জন্য প্রচুর কনস্ট্রাকশনের প্রয়োজন হবে যেখানে পুরকৌশল প্রকৌশলীদের প্রয়োজন হবে । তাই কোন বিষয় থেকে পাশ করে আসছেন, সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ না; গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকা অথবা অধ্যনরত ছাত্রছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদ্রুপ কোর্স করে আসা । পরিকল্পিত উপায়ে প্রস্তুতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা খুব একটা কঠিন হবে না ।
ট্রানজিস্টর এবং চিপের স্বল্পতা কোভিড-১৯ এর আগে এতো প্রকট ছিল না । কিন্তু কোভিডের লকডাউনের সময় মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপের চাহিদা বিশ্বব্যাপী অনেক বেড়ে যায় কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় কারণ মানুষ কর্মস্থলে যেতে পারছিল না । এতে একটা বিশাল ব্যাকলগ তৈরী হয় যা এখনো চলছে । তার সাথে আরো কিছু নতুন প্রযুক্তির উদ্ভব, যেমন ইন্টারনেট অফ থিংস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিং, পরিবেশ বান্ধব ইলেকট্রনিক কার/ভেহিকেল এই সংকটকে আরও তীব্র করে তোলে । কোভিড-১৯ এর আগে যেখানে বিশ্বব্যাপি সেমিকন্ডাক্টর বাজার ছিল ৫২৭ বিলিয়ন ডলারের, ২০২২ সালে সেটি এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৭৩ বিলিয়ন ডলারে । বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন এই বাজার ২০২৯ সালের মধ্যে ১৩৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে । তাই উন্নত বিশ্ব এই সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসায় বিনিয়োগকে একটি ভবিষ্যৎ লাভজনক বিনিয়োগ মনে করছে । এখানে উল্লেখ্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই যে শুধু বিনিয়োগ করছে তা নয়, ইউরোপ এবং দূর প্রাচ্যও দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ করছে । জাপান সরকার ২০২১ সালে তাদের নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৭.৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয় । এছাড়া চায়না ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫০ বিলিয়ন ডলার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে ৫৫ থেকে ৬৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা ইতিমধ্যে দিয়েছে । এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও দেশি বিদেশী সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ১০ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে । তাই ধরে নেয়া যেতে পারে যে, অদূর ভবিষ্যতে এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্প হারিয়ে যাবে না বরং এর চাহিদা অন্তত আগামী এক দশকে বাড়তেই থাকবে ।
No Responses