ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরনের সাংকেতিক ডিজিটাল মুদ্রা। শুধুমাত্র ইন্টারনেট জগতেই মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। বাস্তবে এ ধরনের মুদ্রার কোন অস্তিত্ব নেই। এটি এমন এক ধরনের মুদ্রা, যা কোন দেশের সরকার গতানুগতিক নোট টাকার মতো করে ছাপায় না। বরং এই অর্থ বা ভার্চুয়াল মুদ্রাগুলো তৈরি করা হয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের দ্বারা অসংখ্য কোডের মাধ্যমে।
এই টিউনে ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। আপনি যদি এখনও পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে থাকেন, তাহলে আজকের এই টিউন টি সম্পূর্ণ Continue করতে থাকুন; আজকের এই টিউন এর মাধ্যমে আপনি ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও লেনদেন
ক্রিপ্টোকারেন্সি বুঝতে হলে, আমাদের ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে একটু জানতে হবে। ১৯৬০ এর দশকে Diners club নামের এক ধরনের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। যা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে।
বর্তমানে আমরা অনলাইন ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটালি অর্থ আদান-প্রদান করি। এসব সেবার মধ্যে যেমনঃ বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। এছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাংকের অর্থ লেনদেন করার জন্য রয়েছে অনলাইন লেনদেনের সুবিধা। আমাদের অর্থ লেনদেন এবং আমাদের অর্থকে গচ্ছিত রাখার বিনিময় এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সার্ভিস চার্জ বাবদ বেশ কিছু টাকা কেটে রাখে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবার সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি গুটি কয়েক লোকের হাতে জিম্মি থাকে। এছাড়া এসব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থের মালিকের গোপন তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয় এবং নানান ধরনের বিধি নিষেধের বেড়াজালে আটকে পড়ে।
এছাড়া আপনি কোন ব্যক্তির সাথে লেনদেন করছেন এবং আপনার একাউন্টে কত পরিমাণে টাকা রয়েছে ইত্যাদি সকল তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এক্ষেত্রে যে কোন সময় তারা আপনার সকল হিসাব বের হতে পারে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি কি?
অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি আরো ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাস্তবিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কোন একজন ব্যক্তিকে যেভাবে নজরদারি করা সম্ভব, তার চাইতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কে ব্যবহার করে কোন একজন ব্যক্তির ব্যাপারে সকল তথ্য খুব সহজেই বের করা সম্ভব।
তাই, কম্পিউটার ভিত্তিক যোগাযোগের ব্যাপক প্রচলন হবার পর থেকে মানুষ এমন এক ধরনের মুদ্রার স্বপ্ন দেখে আসছে, যা কোন ধরনের তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই পরিচালিত হবে।
২০০৮-২০০৯ সালের দিকে সাতোশি নাকামোতো নামের এক ছদ্মবেশী চরিত্র এই সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। তিনি ক্রিপ্টোকারেন্সি এর জনক হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এই সাতোশি নাকামোতো আসলে কে, তা কেউ জানে না।
এটি কি কোন একক ব্যক্তির নাম, নাকি একদম সফটওয়্যার বিজ্ঞানী, তাও জানা যায় না। তবে সাতোশি নাকামোতো কে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েন এর জনক বলা হয়।
প্রকৃত সাতোশি নাকামোতো হয়তোবা এটিও চায় না যে, কেউ তাকে খুঁজে বের করুক অথবা তারপরিচয় সম্পর্কে জানুক। ক্রিপ্টোকারেন্সি মূল ধারণাই হলো যে কেউ তারপরিচয় গোপন করে নিরাপদে সাধারণ মুদ্রার মতোই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে পারবে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেন করাই যেহেতু গোপনীয়তার সঙ্গে হয়ে থাকে, তাই সঙ্গত কারণে হয়তোবা ক্রিপ্টোকারেন্সি এর জনকের পরিচয় এখনো অজানা।
ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন করতে পরিচয় এর প্রয়োজনীয়তা আছে?
ক্রিপ্টোকারেন্সি ওয়ালেট খুলতে ব্যবহারকারীরা নাম, ঠিকানা বা ব্যক্তিগত তথ্যের কোন ধরনের প্রয়োজন হয় না। ক্রিপ্টোকারেন্সি সরাসরি এক ব্যক্তি থেকে আরেক ওয়ালেটে ট্রান্সফার হয়। এক্ষেত্রে দুই ব্যক্তির মাঝে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের মাঝখানে কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নজরদারি করতে পারেনা।
যেহেতু দুই ব্যক্তির মাঝে নজরদারি করার ক্ষেত্রে কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই, তাই ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন করার ক্ষেত্রে এখানে কেউ নজরদারি করতে পারে না। এক্ষেত্রে কোনো একজন ব্যক্তির কাছে বিটকয়েন ট্রান্সফার করে যদি কোনভাবে কেউ প্রতারিত হয়, তাহলে সেই অর্থ ফেরত আনা অথবা সেই অর্থের ব্যাপারে কোন ধরনের অভিযোগ করার কোন উপায় থাকেনা।
বিটকয়েন ব্যবহার করে লেনদেন করার ক্ষেত্রে যেহেতু কোন ধরনের মনিটরিং করা হয় না, তাই মাদক চোরাচালান, অবৈধ ব্যবসা ইত্যাদি কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিটকয়েনের মাধ্যমে লেনদেন হয়। কেননা এখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন করলেও ব্যাংক থেকে কোন ধরনের নোটিশ করা হবে না।
ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন করার ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো তৃতীয় পক্ষ সেবা প্রদান করে না, তাই এখানে কোনো বাড়তি চার্জ ও নেই। অর্থাৎ, উভয় লেনদেনের মাঝে কোন ধরনের চার্জ কেটে নেওয়া হয় না।
বিটকয়েন ব্যতীত আরো যত সব ক্রিপ্টোকারেন্সি
সাতোশি নাকামোতো এর আবিষ্কৃত প্রথম মুদ্রার নাম বিটকয়েন। বিটকয়েন এর সফলতা এবং জনপ্রিয়তারপর এরকম অসংখ্য ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে চার হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। Ethereum Litecoin, Gold coin সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
তবে এসবের মধ্য থেকে বর্তমানে বিটকয়েন এর দাম সর্বোচ্চ। এছাড়া বর্তমানে বিটকয়েনের প্রতিদ্বন্দ্বী আরো অনেক কিছু কারেন্সি রয়েছে, যেগুলোর দাম ও বর্তমানে আস্তে আস্তে বাড়ছে। বিটকয়েন বা অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি এর পরিমাণ যেহেতু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে, তাই এর চাহিদা অনুপাতে এর দাম বাড়বে অথবা কমবে।
যদি কোনো এক সময়ে মানুষ বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি আর সংগ্রহ না করে, তাহলে সে সময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েনের দাম কমে যাবে। আর দিন দিন যত মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি বা বিটকয়েনের দিকে আগ্রহ দিবে, এক্ষেত্রে এগুলোর দাম তখন বেড়ে যাবে বা যায়।
সর্বপ্রথম সাতোশি নাকামোতো এর যে আবিষ্কারের কারণে ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, তার নাম ব্লকচেইন। চলুন তবে, ব্লক-চেইন সম্পর্কে সামান্য একটু ধারণা নেওয়া যাক।
ব্লক-চেইন কি?
ব্লক-চেইন হলো, তথ্য সংরক্ষণের এক নতুন পদ্ধতি। ব্লক-চেইন কে বলা যায় এক ধরনের লেজার বা হিসাবের খাতা; যা ব্যাংকের মতো ডিজিটাল অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্য সংরক্ষণ করে। কিন্তু এই লেনদেনের হিসাব কোন প্রতিষ্ঠান কাছে কুক্ষিগত থাকে না; বরং এই লেনদেনের তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকে দেখা যায়। এবং প্রতিটি লেনদেন ঘটার সাথে সাথেই হিসেবের খাতা আপডেট হয়ে যায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এর বিশাল হিসেব মিলানো সহজ কাজ নয়, আবার এই কাজ করার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান ও নেই। এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য একদল লোক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে থাকে, এক্ষেত্রে তাদের পরিশ্রম করার বিনিময় হিসেবে বিটকয়েন বা অন্য কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্লক-চেইন সিস্টেম তাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রদান করে থাকে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে ডিজিটাল অর্থ উপার্জন কে বলা হয় মাইনিং। মাইনিং করার জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার এর প্রয়োজন হয়। এছাড়া এ কাজে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। এরকম অনেক মানুষ রয়েছে যারা বিটকয়েন মাইনিং এর মাধ্যমে বিটকয়েন উপার্জন করে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এর ঝুঁকিপূর্ণ দিক
ক্রিপ্টোকারেন্সি এর জন্মই হয়েছে পরিচয় গোপন রেখে নিরাপদে অর্থ লেনদেন করার জন্য। কিন্তু এর পরও এই মুদ্রা ব্যবস্থায় বেশ কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে।
কোন কারনে কম্পিউটার ক্রাস করলে, আপনার ক্রিপ্টোকারেন্সি চিরতরে হারিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত বিপুল পরিমাণ অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কিন্তু সহজ নয়। আর সেই কারণেই অনেকেই তারা তাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি নিরাপদে সংরক্ষণ রাখার জন্য থার্ড-পার্টির ওয়ালেটের আশ্রয় নিয়ে থাকে। এর এটিকে ক্রিপ্টো ব্যাংক বলা হয়।
যদিও ওয়ালেট গুলো ব্যাংকের মতো নয়; বরং মানি এক্সচেঞ্জ এর মত কাজ করে। এসব ওয়ালেট ব্যবহার করে সাধারণ টাকা কে ক্রিপ্টো মানি বা ক্রিপ্টো মানি কে সাধারণ টাকায় পরিণত করা যায়।
বর্তমানে এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান বা এরকম অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে, যারা আপনার কাছের ক্রিপ্টোকারেন্সি বিক্রি করবে এবং আপনার থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনেও নিবে। হ্যাকিং এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এ ধরনের বহু ক্রিপ্টোকারেন্সি কোম্পানি ও তাদের বিপুল অর্থ হারিয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিটকয়েন এক্সচেঞ্জ Bitstamp, Coincheck, MT.GOX, Bitfinex, Ethereum classic সহ অনেক কোম্পানি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এর উপর কোন দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অনেক দেশেই এ ধরনের মুদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসবের মধ্যে যেমন বাংলাদেশেও ক্রিপ্টোকারেন্সি এর লেনদেন করা অবৈধ।
ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরনের বিপ্লবের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে বহুল জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ক্রিপ্টোকারেন্সি তে তাদের লেনদেন সমর্থন করছে। তরুণ প্রজন্ম এই নতুন ধরনের মুদ্রার পেছনে সবচেয়ে বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী বহু কিশোর-তরুণ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে মিলিয়নিয়ার হয়ে গিয়েছে।
শেষ কথা
ক্রিপ্টোকারেন্সি ভবিষ্যৎ বিশ্বের ভার্চুয়াল মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর আগামীতে ক্রিপ্টোকারেন্সি হতে চলেছে বিনিয়োগের অন্যতম একটি মাধ্যম। তবে এটি অত্যন্ত লাভজনক বিনিয়োগের মাধ্যম হলেও এটিতে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ করা ঝুকিপূর্ণ ও বটে।
কেননা, যদি ভবিষ্যতে মানুষ ক্রিপ্টোকারেন্সি এর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ করা লোকেরা পড়বে বিরাট লোকসানে। তবে খুব দ্রুত সময়ে লাখপতি কিংবা কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখলে ক্রিপ্টোকারেন্সি তে বিনিয়োগ করার আইডিয়া তার জন্য।
তবে আপনিও যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি তে বিনিয়োগ করার প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকেন, তবে আপনার দেশের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন কিংবা জমা রাখার আইন মেনে তা করতে থাকুন। ধন্যবাদ