লোগো বলতে কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির পরিচয় বা ব্র্যান্ডিং বোঝায়৷ একটি প্রতিষ্ঠানকে চেনাতে লোগো ডিজাইনের গুরুত্ব অপরিসীম৷ অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ডগুলো আমরা খুব সহজে লোগো দেখেই চিনে ফেলতে পারি৷
অর্থাৎ লোগো ডিজাইনের গুরুত্ব বর্তমান বিশ্বে কতটা ছাপ ফেলে রেখেছে তা বুঝতে বাকী থাকে না। বর্তমানে জনপ্রিয় পেশাগুলোর মধ্যে ক্রিয়েটিভ কিংবা সৃজনশীল মানুষদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পেশা হচ্ছে গ্রাফিক ডিজাইন। তাই আপনি যদি ক্রিয়েটিভ কিংবা সৃজনশীল পেশার পিপাসু হয়ে থাকেন তাহলে এই লেখাটি অবশ্যই আপনার জন্য৷
ইলাস্ট্রেটর মূলত একটি গ্রাফিক ডিজাইন প্যাকেজ প্রোগাম যাতে লেখা, ছবি ইত্যাদির সমন্বয় সাধন করা যায় এবং লোগো, কার্ড কিংবা ব্যানার ডিজাইন করা যায়৷ অ্যাডোব ইলাস্ট্রেটর গ্রাফিক ডিজাইনের অ্যাডভান্সড লেভেল টুল যা দিয়ে মূলত শেপ এবং গ্রাফের কাজ করা হয়৷ ফটো এডিটিং করা না গেলেও লোগো এবং টাইপোগ্রাফি ডিজাইন এর কাজে এটি সর্বাধিক ব্যবহৃত।
কেননা ইলাস্ট্রেটরে যে আর্টগুলো করা হয় তা মূলত ভেক্টর শেপ কিংবা ভেক্টর ফরম্যাটে ক্রিয়েট করা হয়ে থাকে৷ ভেক্টর শেপের কারণে আর্টগুলো ইচ্ছামতন জুম ইন বা জুম আউট করা যায় এবং ইচ্ছামতন সাইজ প্রদান করা যায়৷ আর সব থেকে মজার ব্যাপার হলো এতে করে আর্ট রেজ্যুলিউশন কিংবা পিক্সেল বিন্দুমাত্রও কমে না। বরং একটি ছোট্ট এটিএম কার্ড থেকে শুরু করে বিলবোর্ড পর্যন্ত ডিজাইনের সামর্থ্য রাখে ইলাস্ট্রেটর৷
অ্যাডোব ইলাস্ট্রেটর ব্যাবহার করে লোগো ডিজাইন পদ্ধতি ধাপে ধাপে উল্লেখ করা হলো-
ধাপ-১ঃ লোগো কন্সেপ্ট নির্ধারণ করা
লোগো ডিজাইনের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ধাপটি হলো লোগো কন্সেপ্ট৷ কোনো গাড়ির কোম্পানী, ফুড কোম্পানী অথবা সোশ্যাল সাইটের লোগো কন্সেপ্ট নিশ্চয়ই কখনো একটা আরেকটার সাথে মিলবে না৷ যেমন, গাড়ির কোম্পানীর লোগোতে গাড়ির ছবি এবং খাবারের কোম্পানীর লোগোতে খাবারের ছবি থাকাটা যতটা স্বাভাবিক, এর বিপরীতটা হওয়া ততটাই অস্বাভাবিক৷ কেননা একটা লোগো একটা কোম্পানীর পরিচয় বহন করে৷ তবে আপনার যদি লোগো কন্সেপ্ট নাও থাকে, ইন্টারনেটের যুগে সেটা কোন বড় সমস্যা অবশ্যই নয়৷ কেননা যেকোন লোগো কন্সেপ্ট আপনি খুব সহজেই ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন৷
ধাপ-২ঃ মৌলিক শেপ প্রদানের জন্য ব্যবহৃত টুলস
গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ধাপটি হলো মৌলিক শেপের প্রয়োগ ঘটিয়ে কমপ্লেক্স আর্ট ক্রিয়েট করা৷ মৌলিক শেপ বলত চতুর্ভুজ, বৃত্ত কিংবা ত্রিভুজ কে বোঝাচ্ছে৷ এগুলোর সমন্বয়ে আর্ট ক্রিয়েট করার মত গুরুত্বপূর্ণ সকল টুল এডোব ইলাস্ট্রেটরে রয়েছে৷ কোন আর্টওয়ার্ক শুরু করার আগে এগুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অবশ্যই রাখতে হবে৷ শেপ তৈরী করার জন্য ব্যবহৃত টুল গুলো হলো- এক্লিপ্স টুল, রেক্টেংগেল টুল, পেন টুল, পেনসিল টুল ইত্যাদি৷
এক্লিপ্স টুল এমন একটি টুল যার সাহায্যে গোলাকার বৃত্ত অংকন করা যায়৷ এই এক্লিপ্স গ্রুপের আরো কয়েকটি টুল হলো – পলিগন টুল( ত্রিভুজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভুজের চিত্র অংকন করা যায়) , স্টার টুল ( স্টার চিহ্ন অংকন) , স্পাইরাল টুল (প্যাচানো চিত্র অংকন)।
অপরদিকে রেক্টিংগেল টুল ব্যবহৃত হয় চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র এবং বর্গক্ষেত্র ক্রিয়েট করতে৷ শেপ কে মনমত ফরম্যাটে রূপান্তর করার জন্য পেন টুল ও পেন্সিল টুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ যেকোন আঁকাবাকা ডিজাইন করা, লাইন যোগ করা, লাইন বিয়োগ কিংবা লাইন সংশোধন করার মতন প্রয়োজনীয় কাজগুলো করা হয়ে থাকে পেন টুল দিয়ে৷
পেন্সিল টুল দিয়ে সুবিধামত লাইন, ছবি, প্রচ্ছদ অংকন করা যায় এবং এর অন্তর্গত স্মুথ টুল দিয়ে ছবি সংশোধন এবং ইরেজ টুল দিয়ে ছবিকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা যায়৷ অর্থাৎ অনন্য ও আকর্ষণীয় ডিজাইন ক্রিয়েট করার জন্য যতগুলো শেপ লাগে তার সবটাই রয়েছে অ্যাডোব ইলাস্ট্রেটরের এই শেপ মেকিং টুলগুলোয়৷
ধাপ-৩ঃ লোগোতে কালার সংযোজন
লোগো ডিজাইনের তৃতীয় এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি হলো কালার সংযোজন৷ এ জন্য যে টুলটি রয়েছে তা হলো পেইন্ট ব্রাশ৷ পেইন্ট করে লাইন বা ছবি আঁকতে এ টুলের প্রয়োজন হয়৷ আপনার পছন্দমতো যেকোন রং যেকোন শেডে ব্যবহার করতে পারেন এই পেইন্ট ব্রাশের সাহায্যে৷
লোগোর শেপ, প্যাটার্ন অনুযায়ী যেকোন কালার প্রাইমারি পর্যায়ে ব্যবহার করলে মূলত ডিজাইন করাটা আরো বেশী সুবিধাজনক হয়৷ তবে ডিজাইন এর কাজ সম্পূর্ণ হলে কোন কালারটি লোগোকে আকর্ষণীয় করছে বা আপনার কাংখিত প্রতিষ্ঠানের সাথে মানানসই হচ্ছে, এসব মাথায় রেখে আপনি প্রয়োজনমত কালার কম্বিনেশন পরিবর্তন ও করতে পারবেন।
ধাপ-৪ঃ কালার ব্লেন্ড করা
চতুর্থ ধাপটি হলো কালার ব্লেন্ডিং। ব্লেন্ড টুলের সাহায্যে একাধিক অবজেক্টের মধ্যে কালার শেপ এর সংমিশ্রণ ঘটানো হয়৷ যেমন একটি ত্রিভুজ ও এর ভিতর একটি বৃত্ত তৈরী করে দুইটিকে আলাদা কালার দিয়ে এই টুল সিলেক্ট করার পর একটি একটি করে দুইটি কালার এর উপর ক্লিক করলেই কালার ব্লেন্ড হয়ে যাবে৷
এই টুলের অন্তর্ভুক্ত আরেকটি টুল হলো অটো ট্রেস টুল যা দিয়ে আউটলাইন শনাক্ত করে কালার শেড প্রদান করা হয়৷ ডিজাইনের এট্রিবিউটের ধরণ প্রদর্শন এর জন্য আরো কয়েকটি টুল হলো গ্রেডিয়েন্ট মেশ টুল ( কালারের সংমিশ্রণ ঘটায়), গ্রেডিয়েন্ট টুল ( গ্রেডিয়েন্টের স্টাইল পরিবর্তন করে), আইড্রপার টুল( অবজেক্টের নির্দিষ্ট কালার কিংবা অ্যাট্রিবিউট ধারণ প্রদর্শন করে)।
ধাপ-৫ঃ লোগোতে টেক্সট বা লেখা সংযোজন
পঞ্চম ধাপটি হলো লেখা সংযোজন৷ টাইপসেটিং ফিচার ব্যবহার করে লোগোতে খুব সহজেই বিজনেস নেম সংযোজন করা যায়৷ এডোব ইলাস্ট্রেটর লাইব্রেরিতে সার্চ করলে অনেক ধরণের অনেক শেপের ফন্ট পাওয়া যাবে।
আবার টাইপ টুল দিয়ে নিজের ইচ্ছামত রং ব্যবহার করেও কেউ লেখা সংযোজন করতে পারেন৷ টাইপ টুল হলো এমন একটি টুল যা দিয়ে লেখা সংযোজন এবং টেক্সট বক্স এডিটিং করা যায়৷ এছাড়াও পেন টুল কিংবা পেন্সিল টুল দিয়ে ফ্রি হ্যান্ড লেখা সংযোজন করে লেখায় অন্যমাত্রা যোগ করা যায়।
ধাপ-৬ঃ লোগো সেভ করা
সর্বশেষ ধাপটি হলো লোগো ডিজাইন শেষে একবার রি-চেক করা এবং লোগোটি সেভ করা। জুম টুল, ফুল স্ক্রিন মোড উইথ মেনুবার বাটন, ফুলস্ক্রিন মোড বাটন টুলগুলো ব্যবহার করে সেভ করতে পারলেই সংরক্ষিত লোগোটি আপনি পিডিএফ ফরমেটে শেয়ার করতে পারবেন ওয়েবে ৷
তবে লোগো ডিজাইনের সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। যেমন- লোগোর মধ্যে ডিজাইনের অতিরঞ্জন পরিহার করতে হবে৷ যত কম উপাদান ব্যবহার করবেন আপনার লোগো ততবেশী আকর্ষণীয় হবে৷ সময়ের সাথে সাথে বদলায় ফ্যাশন অথবা ট্রেন্ড৷ সেক্ষেত্রে দর্শক যাতে উৎসাহ না হারিয়ে ফেলে সেজন্য পরিবর্তন, নতুনত্ব আনতে হবে লোগো ডিজাইনে।
যে কোম্পানির জন্য লোগো তৈরি করবেন তার কাছ থেকে সব রকম তথ্য এবং তাদের উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে লোগো বানাতে বসুন৷ তবে কোনমতেই লোগো নকল করার মতন ভুল করবেন না৷ লোগো ডিজাইনে আনুন নিজস্বতা। তবে নিজস্বতা আনতে গিয়ে বেশি ফন্ট ব্যবহার করা যাবেনা৷ এতে লোগোটি তার প্রধান মেসেজটিই হারিয়ে ফেলতে পারে।
সর্বোচ্চ দুটো ফন্ট ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলতে পারেন আকর্ষণীয় লোগো৷ বর্তমানে লোগো ডিজাইনের চাহিদা অনেক বেশী সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রফেশনাল লোগো ডিজাইনারের চাহিদা৷ তাই পেশাদার লোগো ডিজাইনার হতে গেলে শিখতে হবে নিত্যনতুন পেশাদারি কায়দা৷ নিজেকে একজন দক্ষ লোগো ডিজাইনার হিসাবে তুলে ধরতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং করেও প্রতিমাসে ভালো পরিমাণ আয় করা সম্ভব৷