ক্যাপচা কী, কিভাবে কাজ করে, কত ধরণের হয়- এসব প্রশ্নের উত্তর জানুন আজই

ইন্টারনেটের জগতে ‘I am not a robot(আমি রোবট নই)’ লেখাটি দেখেননি কিংবা এই লেখাটি দেখে বিরক্ত হননি এমন মানুষ পাওয়াই দুষ্কর৷ যেকোন ওয়েবসাইটে প্রবেশ থেকে শুরু করে অনলাইনে কোন অ্যাকাউন্ট ওপেন করতে গেলেই রোবট নয়, মানুষ হিসেবে প্রমাণ দেয়ার প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে ক্যাপ (CAPTCHA)। অর্থাৎ ক্যাপচা হলো একটি প্রয়োজনীয় বিরক্তি যা মানুষকে একটি সুরক্ষিত ওয়েবসাইট উপহার দিতে রোবট কিংবা স্প্যামের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে।

ক্যাপচা কি?

ক্যাপচা কোন বাংলা বা ইংরেজি শব্দ নয়৷ বরং এটি কমপ্লিটলি অটোমেটেড পাবলিক টিউরিং টেস্ট টু টেল কম্পিউটার্স অ্যান্ড হিউম্যান্স অ্যাপার্ট-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। একটি কম্পিউটার,  ল্যাপটপ কিংবা মোবাইল স্ক্রিনের বাইরে থেকে মানুষ কিংবা বট যে কেউ তা অপারেট করতে পারে। মানুষ এবং বট বা রোবটকে আলাদা করার উদ্দেশ্যেই ক্যাপচার সৃষ্টি হয়েছে৷

১৯৯৭ সালে ইয়াহু(Yahoo) তে হাজার হাজার ইমেইল এড্রেস খুলা হয়েছিল স্প্যাম বট এর মাধ্যমে৷ তারপর থেকেই একপ্রকার হইচই পড়ে যায় কীভাবে এই স্প্যাম  রোধ করা যায় তা নিয়ে। সেই সালেই লুইস ভোন আহনের হাত ধরে ইন্টারনেট জগতে প্রবেশ করে ক্যাপচা, যদিও অফিশিয়ালি এর নামকরণ করা হয় ২০০৩ সালে৷

এখন প্রশ্ন আসতে পারে একটা আঁকাবাঁকা যাচ্ছেতাই লেখাযুক্ত একটা ইমেজ যা কিনা ক্যাপচা নামে পরিচিত, সেটি কিভাবে বট আর মানুষকে আলাদা করবে কিংবা কিভাবে স্প্যামিং আটকাবে। ধরুন, ঈদের আগে রেলওয়ে টিকিট কাউন্টারে অনলাইন টিকিট বিক্রয়ের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হলো৷

এখন এই সুযোগে কোন কম্পিউটার প্রোগ্রামার এমন কোন ইন্টিলিজেন্ট প্রোগ্রাম তৈরী করবে যার সাহায্যে সে প্রথমদিনই অনলাইন থেকে সবগুলো টিকিট একাই কিনে নেবে এবং এটা করতে গেলে তার অবশ্যই একটি শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন প্রযুক্তির বা প্রোগ্রামের দরকার হবে, যেহেতু একা এই কাজটি করা তার পক্ষে অসম্ভব৷ এই প্রোগ্রামের সাহায্যে সে সবগুলো টিকিট আগে থেকে কিনে নেবে এবং টিকিট স্টক আউট হওয়ায় এবং টিকিটের চাহিদা বেশি হওয়ায় সে এই টিকিটগুলো নিজে যে দাম দিয়ে কিনেছে,  তার থেকে আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে।

এভাবে শুরু করবে ব্ল্যাকমার্কেটিং৷ ক্যাপচা এধরণের ব্ল্যাকমার্কেটিং আটকাতে  ভূমিকা রেখে চলেছে এবং একই সাথে আমাদের অনলাইনে কেনাকাটা, টাকা লেনদেন থেকে শুরু করে ওয়েবসাইট ভিত্তিক  প্রতিটি  প্লাটফর্মকে অবৈধ কাজগুলো থেকে  নিরাপত্তা প্রদান করে চলেছে৷

এক্ষেত্রে সার্ভারের বোঝা প্রয়োজন,  যে ডিভাইস  দিয়ে সার্ভারে অ্যাক্সেস করা হচ্ছে তা কি সত্যিকারের কোন মানুষ অপারেট করছে নাকি কোন বট৷ সেটা বোঝার জন্যই বিশেষজ্ঞরা সার্ভারে অ্যাক্সেসের আগমুহূর্তে কিছু টাস্ক প্রদানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, যা মানুষ এর জন্য করা যত সহজ হবে, কোন বটের পক্ষে ততটাই কঠিন হবে। মূলত এই ধরনের চিন্তাভাবনা থেকেই ক্যাপচার সৃষ্টি এবং ব্যবহারের শুরু হয়।

ক্যাপচা বটের কাছে একটি চ্যালেঞ্জিং টেস্টের মত হলেও মানুষের জন্য একটি টিউরিং টেস্টের মত কাজ করে। ব্যবহারকারীকে এমন একটি ছোট্ট কাজ দেয়া হয় যা কোন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রোগ্রাম কিংবা বটের পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়৷ যেকোন ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেসের আগমুহূর্তে, অ্যাকাউন্টে লগইন কিংবা অনলাইন ফরম ফিলআপের আগমুহূর্তে ফরমের নিচে একটি ইমেজ বা ছবি দেয়া থাকে। ছবিতে কতকগুলো ক্যারেক্টার বিকৃতভাবে কিংবা আঁকাবাকাভাবে উপস্থাপন করা থাকে৷

ক্যারেক্টরগুলো হতে পারে কোন বর্ণ বা অংক৷ তবে এই বর্ণ কিংবা অংকগুলো আমরা সচরাচর যেভাবে দেখে বা লিখে থাকি,  সেভাবে না থেকে অবিন্যস্ত বা ঢেউ খেলানো রূপে থাকে। ব্যবহারকারীকে নির্দিষ্ট বক্সে সেগুলো প্রবেশ করাতে বলা  হয়।  কিন্তু  ক্যাপচার শব্দ বা বর্ণগুলো মাঝেমাঝে এতটাই অবিন্যস্ত আকারে থাকে যা শুধু রোবট কেন,  মানুষের পক্ষেই বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য অনেক সাইটে ক্যাপচা পরিবর্তন করার কিংবা অডিও শোনার সুযোগ আছে৷ বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে  একজন মানুষের গড়ে ১০ সেকেন্ড সময় লাগে এই ক্যাপচা সমাধান করতে৷

ক্যাপচা যেভাবে কাজ করেঃ

ক্যাপচা মূলত ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা গেটের মত কাজ করে৷ এর কোন কোনটা সমাধানে যেমন কঠিন হয়,  কোন কোনটা সমাধানে তেমনই সহজ কিংবা মজারও হয়৷ ক্যাপচা সমাধানের ধরণভেদে একে কয়েক প্রকারে বিভক্ত করা হয়।  এ পর্যায়ে, চলুন জেনে নিই ক্যাপচার এই প্রকারভেদ সম্পর্কে-

অডিওর বিকল্প সহ স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার্ড ক্যাপচা ( The standard word captcha with an audio option

সবচাইতে বেশী ব্যবহৃত ক্যাপচা হচ্ছে ওয়ার্ড ক্যাপচা৷ যখনই কোন সাইটে প্রবেশের পূর্বে নিরাপত্তা চেক-ইনের প্রয়োজন হয় তখন এই স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার্ড ক্যাপচাটি প্রদর্শিত হয় এবং ব্যবহারকারীকে প্রদর্শিত শব্দটি লিখতে হয়৷ তবে অতিরিক্ত বিকৃত শব্দের চিত্রগুলি সমাধান করা কঠিন হলে নতুন আরেকটি ক্যাপচা পেতে পুনরায় ক্লিক করতে বলা হয়৷ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় রিক্যাপচা(recaptcha)। কিন্তু বর্ণ বা শব্দ বুঝতে অক্ষম হলে সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে অডিও ক্যাপচাও রয়েছে৷ ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপ্লিকেশন ডেভলপমেন্ট এর ক্ষেত্রে এধরণের ক্যাপচা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়৷

ছবি শনাক্তকরণ ক্যাপচা ( Picture identification of captcha)

ব্যবহারকারী যদি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী না হয়ে থাকেন তবে ছবি শনাক্তকরণ ক্যাপচা ব্যবহারকারীদের জন্য অন্যতম মজার একটি ক্যাপচা যা সমাধানেও খুব সহজ৷ এধরনের ক্যাপচায় কয়েকটি ছবি সংযুক্ত করা থাকে এবং কোন ছবিটি সিলেক্ট করতে হবে তার নির্দেশনা দেয়া থাকে। যেমন: বাঘ, পান্ডা এবং ঘোড়ার ছবি দিয়ে যদি ‘horse’ চিহ্নিত করতে বলা হয় তাহলে ব্যবহারকারী খুব সহজেই ঘোড়ার ছবিটি চিহ্নিত করতে পারবে যদি ব্যবহারকারী কোন সত্যিকারের মানুষ হয়ে থাকে৷

অঙ্ক সমাধান (Math solution)

এ ক্যাপচাটির নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে অঙ্কের সমাধান করতে দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে খুব সহজ এবং সাধারণ মানের গাণিতিক সমস্যা ব্যবহার করা যায়,  যেগুলো খুব সহজেই পড়া যায় এবং সমাধান করা যায়৷ যেমন : এন্টার কোডের  জন্য  প্রদর্শিত ইমেজে 1+3  অথবা 1+1,  এরূপ সমাধান চাইতে পারে। আপনি যদি কাঙ্খিত ওয়েবসাইটটিতে অ্যাক্সেস পেতে এমন সাধারণ  মানের অঙ্কের সমাধান দিতে না পারেন তাহলে বুঝে নিতে হবে ওয়েবসাইটটি এমন কারো অ্যাক্সেস চায় না।

থ্রিডি ক্যাপচা ( 3D captcha)

থ্রি-ডি ক্যাপচা সুপার ক্যাপচা নামেও পরিচিত৷ কারণ এ ক্যাপচায় ভিন্ন ভিন্ন থ্রি-ডি ছবি থাকে যেগুলো থ্রি-ডি ছবি বা বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত। ফলে ব্যবহারকারীর পক্ষে এ ধরনের ক্যাপচা সমাধান কখনো কখনো কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে৷

অ্যাডইনজেক্টেড ক্যাপচা ( Ad-injected captcha)

এ ধরনের ক্যাপচা কোডের ক্ষেত্রে কোন ব্র্যান্ডের নাম লেখা ছবি প্রদর্শন করে।এভাবে ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে এই ধরণের ক্যাপচা ওয়েবসাইটকে অতিরিক্ত আয় করতেও সাহায্য করে৷

জেকুয়েরী স্লাইডার ক্যাপচা ( jQuery slider captcha)

এটা ব্যবহারে খুবই সহজ৷ স্লাইডের দুপাশে লকড (locked) এবং আনলকড (unlocked) লেখা থাকে। ব্যবহারকারীকে শুধুমাত্র স্লাইড করে আনলক করতে হয়৷

ড্র্যাগ এবং ড্রপ ক্যাপচা ( Drag and drop captcha)  

এটা অনেকটা জে-কুয়েরী স্লাইডার ক্যাপচার মতই৷ এটি সমাধান করতে খুব সহজ একটা শূণ্যস্থান পূরণ, মিল করণ বা পুনর্বিন্যাসকরণ করতে হয়৷ এ ধরণের ক্যাপচা সমাধান করতে নির্দেশনা অনুযায়ী কখনো প্রদর্শিত ছবি অনুসারে খালি ঘরে মিসিং ক্যারেক্টার ড্র্যাগ করে আনতে হয়, কখনো সংশ্লিষ্ট ছবি বা ক্যারেক্টারকে ড্র্যাগ করে সংযুক্ত করতে হয়, আবার কখনো কোন শব্দকে ভুল জায়গা থেকে ড্র্যাগ করে এনে সঠিক জায়গায় বসাতে হয়।

টিক ট্যাক টো ক্যাপচা ( Tic tac toe captcha)

অবসরে কিংবা পড়ার ফাঁকে খেলতে গিয়ে টিক ট্যাক টো খেলাটির সাথে পরিচয় ঘটেনি, এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে।   ক্যাপচা ডিজাইনে এমন খেলার সংযোজন ক্যাপচাকে মজাদার রূপে উপস্থাপন করে।পাশাপাশি এর সমাধান নিশ্চিত করে যে ওয়েবসাইটটি কোন মানুষই ব্যবহার করছে।

সাধারনণত দেখা যায়, অনেক সময়ই কোন ভিডিও বা ওয়েবসাইটে অ্যাক্সেস  করতে গিয়ে বারবার ক্যাপচা প্রদান করতে হলে আমরা বিরক্ত হই। কিন্তু যখন আমরা জানবো যে এর ব্যবহার আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই,তখন নিশ্চয়ই আমরা আগের চাইতে সতর্কতা আর মনযোগের সাথে এর সমাধান করব। সে উদ্দেশ্যেই আমাদের আজকের লেখা। আশা করছি আমাদের আজকের এই পোস্ট থেকে আপনারা নতুন কিছু জানতে পেরেছেন।

Add Comment