মুদ্রণ শিল্পের আবিষ্কার না হলে এখনো আমরা অনেকেই অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে জানতে পারতাম না! এমনকি অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও আমাদের কাছে পৌঁছাতে হয়তো কয়েক শতাব্দী সময় লাগতো। অতএব আমাদের মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান রাখা প্রয়োজন।
মুদ্রণশিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
এই নিবন্ধে আমরা মুদ্রণশিল্পের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করবো। যেমন-
১ম পর্যায়: উডব্লক প্রিন্টিং-
৬ষ্ঠ শতাব্দীর চীনে ট্যাং রাজবংশের শাসনামলে উদ্ভূত অনেকগুলো আবিষ্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো উডব্লক প্রিন্টিং। এই পদ্ধতিতে কাঠের ম্যাট্রিক্স-এর উপর খোদাই করে তা কালিতে ডুবিয়ে কাগজের উপর ছাপ বসিয়ে মুদ্রণের করা হতো। উডব্লক প্রিন্টিং পদ্ধতিতে মুদ্রিত প্রথম বই হলো ‘Diamond Sutra’ (৮৬৮ খ্রি:)।
২য় পর্যায়: মুভেবল মুদ্রণ ব্যবস্থা-
এটি মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এবং এসময়ও চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১০৪১-এ চীনা মুদ্রক বি শেঙ মাটির তৈরী চলন্ত মুদ্রণ ব্যবস্থার আবিষ্কার করেন। যদিও এর কিছু ত্রূটি ছিল যেকারণে সহজেই এটি ভেঙে যাবার সম্ভাবনা ছিল.
পরবর্তীতে ১২৯৮ খ্রি: আরেক চীনা মুদ্রক ওয়াং ঝেন প্রিন্টিং এর ম্যান উন্নয়নের জন্য আরো শক্তিশালী কাঠের মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৫ শতকের দিকে ইউরোপে জোহান্স গুটেনবার্গ একটু ভিন্ন ধরণের চলমান মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন ঘটান। গুটেনবার্গের মুদ্রণ যন্ত্রে সর্বপ্রথম তেল- ভিত্তিক কালী ব্যবহার করা হয়, যা পূর্বে ব্যবহৃত পানি- ভিত্তিক কালির তুলনায় বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছিল।
এই মেশিনের টাইপিং এর অংশটুকু টিন, সীসা এবং এন্টিমনির সমন্বয়ে তৈরি বিধায় অন্য মেশিনের তুলনায় এর টাইপিং বেশি দৃঢ় হতো।
১৪৫৫ সালের ২৩ ফেব্রূয়ারি, দীর্ঘ ১ বছরের পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষে তিনি এই মেশিনের দ্বারা প্রথমবারের মতো বাইবেলের ১৮০ কপি প্রিন্ট করেন।
৩য় পর্যায়: রোটারি প্রিন্টিং প্রেস-
এই পর্যায়ে ১৮৪৩ সালে আমেরিকার রিচার্ড হোয়ে রোটারি প্রেসের আবিষ্কার করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এই পদ্ধতিতে হাতে করে একটি একটি কাগজের শিট মেশিনে দিয়ে প্রিন্ট করতে হতো।
পরবর্তীতে উইলিয়াম বুলক ১৮৬৩ সালে এমন একটি প্রেসের আবিষ্কার করেন যেটিতে একবারে একটি পেপার রোল মেশিনে দিয়ে দেয়া যেতো।
এই ধরণের মুদ্রণযন্ত্রগুলো ঘন্টায় ৮০০০ পৃষ্ঠা মুদ্রণ করতে সক্ষম ছিলো যা তৎকালীন মুদ্রণ ব্যবস্থাকে ত্বরান্বিত করেছিলো।
উল্লেখ্য, ১৮৪৬ সালে রোটারি প্রেসের ব্যবহার শুরু হয় ফিলাডেলফিয়া পাবলিক লেজার মুদ্রণের মাধ্যমে।
৪র্থ পর্যায়: অফসেট প্রিন্টিং-
১৮৭৫ সালে রবার্ট বার্কলে ধাতব মাধ্যমে মুদ্রণের জন্য অফসেট প্রেসের প্রবর্তন করেন যা ১৯০৪ সালে ওয়াশিংটন রুবেল কাগজে প্রিন্টের জন্য ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে প্রিন্টের জন্য পানি ও তেলের বিকর্ষণের বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করা হয়।
অফসেট প্রিন্টিংয়ের সুবিধা হলো-
- এর মাধ্যমে নিখুঁত এবং পরিষ্কার ছবি মুদ্রণ করা সম্ভব।
- এই পদ্ধতিতে যেকোনো রকম কাগজ এমনকি অমসৃণ কাগজেও উন্নতমানের প্রিন্ট করা সম্ভব।
অফসেট প্রিন্টিংয়ের একমাত্র অসুবিধা হলো এর মেশিনটি অনেক বড়, যা রক্ষনাবেক্ষন যথাযথ সময় গুরুত্ব দিতে হয়। যেকারণে এই পদ্ধতি একটু ব্যয়বহুল কিন্তু বড় মাপের প্রিন্টিং কাজের জন্য যথার্থ।
৫ম পর্যায়: লাইনোটাইপ মেশিন-
১৮৮৫ সালে জার্মান বংশোদ্ভূত উদ্ভাবক ওটমার মেরজেন্টহেলার টাইপসেটিং মেশিন লিনোটাইপ তৈরি করেছিলেন। এটি অনেকটা টাইপরাইটারের মতো কাজ করতো। লাইনোটাইপ প্রিন্টিং স্বয়ংক্রিয় ছিলো বিধায় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রিন্টিংয়ের গতি বাড়িয়েছিলো।
১৮৮৬ সালে এই মেশিনটি প্রথম ব্যবহার করা হয় নিউ ইয়র্কের সংবাদপত্র ‘নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন’ মুদ্রণের জন্য পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে ইতালির অন্যতম প্রধান দৈনিক ‘ট্রিবিউনা‘ মুদ্রণের জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
এই মেশিনের আবিষ্কার মুদ্রণশিল্পকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলো। যে কারণে বিখ্যাত বিজ্ঞানী েকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য্য বলে অভিহিত করেছেন।
৬ষ্ঠ পর্যায়: লেজার প্রিন্টিং-
১৯৭১ সালে জেরক্স কর্পোরেশন লেজার প্রিন্টিং পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলো যার মাধ্যমে মুদ্রণের বিষয়বস্তু বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে সরাসরি কাগজে মুদ্রণ করা সম্ভব হয়েছিলো।
এই ভারী, জটিল এবং ব্যয়বহুল লেজার প্রিন্টারটির সাথে বর্তমানকালের লেজার প্রিন্টারের অনেক পার্থক্য।
পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ক্যানন প্রথম ডেস্কটপ লেজার প্রিন্টার তৈরী করে। এটিও অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল ছিলো।
এরপর ‘৯০ এর দশকের শুরু থেকে লেজার প্রিন্টার সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এবং সময়ের সাথে এটি আরো সস্তা, বহনযোগ্য এবং কার্যক্ষম হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ পর্যায়: 3D প্রিন্টিং-
মুদ্রণশিল্পের সর্বশেষ এবং বর্তমান পর্যায় বা ধাপ হচ্ছে 3D প্রিন্টিং। ১৯৮৩ সালে চাক হাল যখন অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে বার্নিশ শক্ত করতে চেয়েছিলো মূলতঃ তখন এই পদ্ধতিটির উদ্ভাবন হয়। তিনি তাঁর এই আবিষ্কারের নাম দিয়েছিলেন ‘স্টেরিওলিওগ্রাফি’।
প্রাথমিক অবস্থায় এই প্রিন্টিংও অনেক ব্যয়বহুল ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বহুল ব্যবহৃত মুদ্রণ পদ্ধতি।
অর্থাৎ, জ্ঞান- বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে যুগে যুগে মুদ্রণশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এখন অপেক্ষায় রয়েছি মুদ্রণশিল্পের পরবর্তী সংযোজন উপভোগ করার।
আশা করি এর সাথে জড়িতরা আরো আধুনিক এবং কর্মক্ষম যন্ত্র বা পদ্ধতির উদ্ভাবন করে এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।