এই বছরের ২২শে জানুয়ারি বাংলাদেশে শুরু হল ই-পাসপোর্ট অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট বিতরণ কর্মসূচী। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মসূচীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ইপাসপোর্ট চালু হওয়ায় নাগরিকরা ভোগ করতে পারবেন বিভিন্ন রকমের সু্যোগ সুবিধা। চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেয়া যাক ই-পাসপোর্ট এর বিভিন্ন বিষয়।
ইপাসপোর্ট কী?
ই-পাসপোর্ট হল ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপযুক্ত বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট। এই ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর এর মধ্যে রয়েছে বায়োমেট্রিক তথ্য, যা পাসপোর্টধারীর তথ্য বহন করে।
পাসপোর্টধারীর তিন ধরণের ছবি, ১০ আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ স্ক্যান – এসব বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকবে ই-পাসপোর্ট এ। ইলেকট্রনিক বর্ডার কন্টোল ব্যবস্থা (ই-বর্ডার) দ্বারা পাসপোর্ট চিপ এর বাইরের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলনামূলকভাবে যাচাই করা হয়।
পাবলিক কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার (PKI) এর মাধ্যমে পাসপোর্ট চিপ ইলেক্ট্রনিকভাবে ডাটা যাচাই করে। বর্তমানে বিশ্বের ১২০ টি দেশে ই-পাসপোর্ট চালু রয়েছে (বাংলাদেশ ১২০ তম)৷ এই ই-পাসপোর্ট ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে বাস্তবায়িত হলে এই ব্যবস্থায় জালিয়াতি করা অনেকটাই কঠিন হয়ে যাবে।
এমআরপি এবং ই-পাসপোর্ট এর মধ্যে পার্থক্য
এমআরপি অর্থাৎ মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং ই-পাসপোর্ট অর্থাৎ ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট – এই দুটি বাইরে থেকে দেখতে প্রায় একই রকম, তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। ই পাসপোর্টে থাকছে একটি চিপ এবং এন্টেনা যার মাধ্যমে তারবিহীন ভাবে তথ্য যাচাই করা সম্ভব হবে।
এমআরপি পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তথ্য যাচাই বাছাই করে পাসপোর্টে সিল দিয়ে থাকেন। কিন্তু ই-পাসপোর্টধারী যন্ত্রের মাধ্যমে নিজে থেকেই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারেন। তবে পরবর্তী ধাপে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারাই পাসপোর্টে আগমণ অথবা বর্হিগমন সিল প্রদান করবেন।
ই-পাসপোর্ট এর সুবিধা
এমআরপি পাসপোর্ট এর গতানুগতিক সুবিধাগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন ই-পাসপোর্ট হোল্ডারগণ। ই-গেট ব্যবহার করে ভ্রমণকারীরা খুব দ্রুত ও সহজে যাতায়াত করতে পারবেন। ই-পাসপোর্ট ব্যবহার করলে বিভিন্ন বিমানবন্দরে পাসপোর্টধারীদের ভিসা চেকিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবেনা। বরং নিজেই ই গেটে চেকিং এর একটা অন্যতম প্রধান ধাপ সম্পন্ন করতে পারবেন।
এর পাশাপাশি ফিঙ্গারপ্রিন্ট দ্বারা যাচাইয়ের ব্যবস্থাও থাকছে। সব ঠিক থাকলে পাসপোর্টধারী ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতে পারবেন। তবে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় কোনো গরমিল থাকলে তখন সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা উক্ত ব্যক্তির তথ্য যাচাই করবেন। কারো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকলে, সেটিও এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানা যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও) পাবলিক কি ডাইরেক্টরি অর্থাৎ পিকেডি পরিচালনা করে। ফলে ইন্টারপোলসহ বিমান ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য ই-পাসপোর্ট এর মাধ্যমে সহজেই যাচাই করতে পারবে। এ ধরণের পাসপোর্ট জাল করা অত্যন্ত কঠিন হবে।
ই-পাসপোর্ট এর মেয়াদ, বিতরণের সময় ও ফি
নিম্নোক্ত হারে পাসপোর্ট ফি প্রযোজ্য হবে
৪৮ পেজের ই পাসপোর্ট ৫ বছরের মেয়াদ
- ২১ দিনের মধ্যে রেগুলার ডেলিভারি ৪০২৫ টাকা
- ১০ দিনের মধ্যে এক্সপ্রেস ডেলিভারি ৬৩২৫ টাকা
- ২ দিনের মধ্যে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি ৮৬২৫ টাকা
৪৮ পেজের ই-পাসপোর্ট ১০ বছরের মেয়াদ
- ২১ দিনের মধ্যে রেগুলার ডেলিভারি ৫৭৫০ টাকা
- ১০ দিনের মধ্যে এক্সপ্রেস ডেলিভারি ৮০৫০ টাকা
- ২ দিনের মধ্যে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি ১০৩৫০ টাকা
৬৪ পেজের ই-পাসপোর্ট ৫ বছরের মেয়াদ
- ২১ দিনের মধ্যে রেগুলার ডেলিভারি ৬৩২৫ টাকা
- ১০ দিনের মধ্যে এক্সপ্রেস ডেলিভারি ৮৬২৫ টাকা
- ২ দিনের মধ্যে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি ১২,০৭৫ টাকা
৬৪ পেজের ই-পাসপোর্ট ১০ বছরের মেয়াদ
- ২১ দিনের মধ্যে রেগুলার ডেলিভারি ৮০৫০ টাকা
- ১০ দিনের মধ্যে এক্সপ্রেস ডেলিভারি ১০,৩৫০ টাকা
- ২ দিনের মধ্যে সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারি ১৩,৮০০ টাকা
ই-পাসপোর্ট করতে কি কি লাগবে?
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্মনিবন্ধন সনদ (বিআরসি) অনুযায়ী ই-পাসপোর্টের আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে। ১৮ বছরের কম বয়সী আবেদনকারী, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই, তাদের পিতা-মাতার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নম্বর অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
কীভাবে ই-পাসপোর্ট আবেদন করব?
ই-পাসপোর্ট আবেদনের জন্য ৫টি সহজ ধাপ রয়েছে। এই লিংকে ক্লিক করে আপনি অনলাইনে ই পাসপোর্ট আবেদন করতে পারেন। ধাপগুলো নিচে দেয় হলো।
ধাপ ১: বর্তমান বসবাসরত জেলাতে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে কি না দেখুন
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে ধাপে ধাপে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরু হবে। তাই নিজ জেলাতে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রম শুরু হলে আবেদনের প্রস্ততি গ্রহণ করুন। অনলাইনে আবেদনের ক্ষেত্রে বর্তমান ঠিকানা অনুযায়ী জেলা ও থানার নাম অর্ন্তভুক্ত করান। বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস অথবা দূতাবাসের লিস্ট থেকে নির্দিষ্ট অফিস নির্বাচন করুন।
ধাপ ২: অনলাইনে ই-পাসপোর্ট আবেদন ফরম পূরণ করুন
পিডিএফ এডিটরের সহায়তায় ফরম পূরণ করে প্রিন্ট করুন। ই-পাসপোর্ট আবেদন দুইটি প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা যায়।
অনলাইন আবেদন: আবেদন প্রক্রিয়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে। অনলাইন পেমেন্ট অপশন নির্বাচন করুন; এতে আপনার সময় সাশ্রয় হবে।
পিডিএফ আবেদন পূরণ: এখান থেকে ই-পাসপোর্টের পিডিএফ আবেদন ফরম ডাউনলোড করার পর কম্পিউটারে সরাসরি পূরণ করতে পারেন। পূরণকৃত ফরম প্রিন্ট করে প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ (যেমন : জাতীয় পরিচয় পত্র, পুরাতন পাসপোর্ট [যদি থাকে], প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রমাণক) পাসপোর্ট অফিস বা দূতাবাসে যোগাযোগ করুন। তবে সুনিশ্চিত হউন আপনার সংশ্লিষ্ট অফিস/দূতাবাসে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে কি না।
মনে রাখুন: আবেদন অবশ্যই কম্পিউটারে পূরণ করতে হবে। হাতে লেখা কোন আবেদন গৃহীত হবে না।
ধাপ ৩: পাসপোর্ট ফি পরিশোধ
তালিকাভুক্তির জন্য পাসপোর্টের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করুন। আপনি যখন অনলাইন আবেদন করবেন তখন ফি পরিশোধের জন্য অনেক অপশন পাবেন (যেমন: ক্রেডিট কার্ড, বিকাশ ও অন্যান্য) এছাড়া নির্ধারিত ব্যাংকে ফি পরিশোধ এর সুযোগ রয়েছে। যখন ব্যাংক ফি পরিশোধ করবেন তখন পাসপোর্ট আবেদনপত্র সাথে রাখা প্রয়োজন।
ধাপ ৪: ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ
ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়েছেন কি না নিশ্চিত হোন। প্রিন্টেড আবেদনপত্র, পেমেন্ট স্লিপ, জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম সনদ, সর্বশেষ পুরোনো পাসপোর্ট (যদি থাকে) এবং অন্যান্য কাগজপত্র (যেটি আপনি সহায়ক মনে করেন) সঙ্গে রাখুন।
বর্তমানে ঠিকানা অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট অফিসে আবেদন করুন। সকল বাংলাদেশ দূতাবাসে দেশের ঠিকানা অনুযায়ী আবেদন করা যাবে। পাসপোর্ট অফিসে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়াদি যাচাই করা হয়।
- কাগজপত্র ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই
- আবেদনকারীর ফটো তোলা
- আঙ্গুলের ছাপ ও আইরিশের ছবি গ্রহণ
- যথাযথভাবে পাসপোর্ট ফি পরিশোধ হয়েছে কিনা
তালিকাভুক্তির পর সরবরাহকৃত ডেলিভারি স্লিপ সংরক্ষন করুন। পাসপোর্ট গ্রহণের সময় ডেলিভারি স্লিপ/ রশিদ প্রর্দশন বাধ্যতামূলক।
ধাপ ৫: পাসপোর্ট অফিস থেকে ই- পাসপোর্ট সংগ্রহ
আবেদনকারীকে সশরীরে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। পাসপোর্ট সংগ্রহের সময় আবেদনকারীর ফিঙ্গারপ্রিন্টের সাথে এনরোলমেন্টের ফিঙ্গার প্রিন্টের মিল আছে কি না পরীক্ষা করা হবে। পাসপোর্ট সংগ্রহের সময় নিম্ন বর্ণিত প্রমাণক সাথে আনতে হবে।
- ডেলিভারী স্লিপ/রশিদ: এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর প্রদেয় স্লিপ
- সর্বশেষ পুরানো পাসপোর্ট (যদি থাকে)।
বিশেষ ক্ষেত্রে উপযুক্ত বাহকের কাছে পাসপোর্ট প্রদান করা যেতে পারে।
- ১১ (এগার) বছরের কম বয়সী সন্তানের পিতামাতা/বৈধ অভিভাবক নিজের জাতীয় পরিচয় পত্র, আবেদনকৃত পাসপোর্ট ডেলিভারি স্লিপ/রশিদ ও পূর্বের পাসপোর্ট (যদি থাকে) প্রদর্শন সাপেক্ষে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।
- অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর পত্র, আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, পুরাতন পাসপোর্ট (যদি থাকে) এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র, পুরাতন পাসপোর্ট (যদি থাকে) যাচাই সাপেক্ষে পাসপোর্ট প্রদান করা হতে পারে।
ই-পাসপোর্টেও কি ভিসা নিতে হবে?
প্রচলিত ব্যবস্থার মতো ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ভিসার বিষয়টি একই থাকবে। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের নিয়ম অনুযায়ী স্বশরীরে বা অনলাইনে ভিসার শর্ত পূরণ করেই ভিসা নিতে হবে।
ভিসা কর্তৃপক্ষ বা দূতাবাসগুলো এই পিকেডি ব্যবহার করে আবেদনকারীর তথ্য যাচাই করে নিতে পারবে। এরপরে তারা পাসপোর্ট বইয়ের পাতায় ভিসার অনুমতিসূচক স্টিকার, সিল দিতে পারবে বা ভিসা বাতিল করে দিতে পারবে।
এমআরপি পাসপোর্ট কি বাতিল হয়ে যাবে?
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত ই-পাসপোর্টের পাশাপাশি প্রচলিত এমআরপি পাসপোর্ট ব্যবস্থাটিও চলতে থাকবে। তবে নতুন করে যারা আবেদন করবেন কিংবা যাদের আগের পাসপোর্ট (এমআরপি) তাদেরকে ইপাসপোর্ট দেওয়া হবে। বর্তমানে এমআরপি পাসপোর্টধারীরা যখন নবায়ন করতে যাবেন, তখন তাদেরকে ই-পাসপোর্ট দেয়া হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সব এমআরপি পাসপোর্ট তুলে নেয়া হবে।
ই-পাসপোর্ট সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে পারবেন এই সাইটে।
পোস্ট টি ভাল লাগলে শেয়ার করতে পারেন। আপনার বন্ধুদের এই তথ্য জানার সুযোগ দিন। টেকটিউন্স এর সাথেই থাকবেন। ধন্যবাদ।
রেফারেন্সঃ banglatech24
আরও জানুনঃ অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাউনলোড করার উপায়