আর চলবে না অবৈধ মোবাইল ফোন ( এনইআইআর )

অবৈধ পথে দেশে আসা, ক্লোন বা চুরি করা হ্যান্ডসেটের দিন ফুরাচ্ছে। চালু হতে যাচ্ছে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর)। ফলে অবৈধ হ্যান্ডসেট দিয়ে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে আর যোগাযোগ করা যাবে না।

এনইআইআর চালুর পরে এসব ফোনে একেবারেই কোনো মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম চলবে না। বিস্তারিত জানাচ্ছেন আল আমীন দেওয়ান

এনইআইআর কী?

সোজা কথায় দেশের আইন ও নীতি অনুযায়ী নির্ধারিত অবৈধ হ্যান্ডসেটকে দেশের মোবাইল অপারেটরদের নেটওয়ার্কে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রযুক্তিগত সিস্টেম। যে সিস্টেমে অবৈধ পথে দেশে আসা ক্লোন বা চুরি করা হ্যান্ডসেট আলাদা করে ফেলা যাবে। এতে বিটিআরসি একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম বা কমন সার্ভার করবে। এটি স্থাপন করছে বিটিআরসির নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান বা কম্পানি। এই সার্ভার দেশের আইএমইআই ডাটাবেজ (কম্পিউটারে সংরক্ষিত তথ্যভান্ডার) এবং দেশের সব মোবাইলফোন অপারেটরে সক্রিয় থাকা সিমের সঙ্গে হ্যান্ডসেটগুলোর ডাটার সিঙ্ক্রোনাইজ করে তা যাচাই-বাছাই করতে পারবে।

যেভাবে কাজ করবে এনইআইআর

নক অটোমেশন অ্যান্ড আইএমইআই ডাটাবেজ (এনএআইডি) সিস্টেমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি আইএমইআই নম্বর সংযোজন হয়েছে।

এই সিস্টেমের আইএমইআইসমূহ, মোবাইল অপারেটরের ইআইআর এবং বিটিআরসিতে স্থাপিত জাতীয় পর্যায়ের কেন্দ্রীয় এনইআইআর একটি সমন্বিত সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। এনইআইআর সিস্টেমটি সরাসরি প্রত্যেক মোবাইল অপারেটরের নিজ নিজ ইআইআরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

গ্রাহকদের মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিবন্ধিত হয়ে চালু হবে। এনইআইআর সব হ্যান্ডসেটের বৈধতা যাচাইয়ের মাধ্যমে মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট চালুর বিষয়ে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত দেবে।

আইএমইআই ডাটাবেজ কী?

মোবাইল ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে স্থাপন করা হয়েছে আইএমইআই সংক্রান্ত এই ডাটাবেজ। সেখানে মোবাইল ফোন অপারেটরদের আমদানি করা সব ফোনের আইএমইআই সংক্রান্ত তথ্য এরই মধ্যে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটদের নেটওয়ার্কে থাকা আইএমইআইও রাখা হচ্ছে সেখানে।

এই ডাটাবেজের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে হ্যান্ডসেটটি বৈধ পথে আমদানি করা কি না। হ্যান্ডসেট আমদানিকারকরা তাদের আমদানির অনাপত্তিপত্র নিয়ে থাকেন অনলাইনেই। এই পদ্ধতিতে কাস্টম হাউসের জন্য আলাদা মডিউল এবং একটি ডিভাইস থাকবে, যা দিয়ে কমিশনের অনাপত্তিপত্রে থাকা আইএমইআই নম্বর যাচাই করে শুল্কায়ন করা যাবে। এতে ভুল আইএমইআই নম্বরের মোবাইল ফোন দেশে আসতে পারবে না। এখন পর্যন্ত ১৪ কোটি আইএমইআই নম্বর এই ডাটাবেজে নিবন্ধিত হয়েছে।

এনইআইআর বাস্তবায়ন করছে কারা?

ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) বা অবৈধ ফোন বন্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে কম্পানি নির্বাচিত করে এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে বিটিআরসি। চলতি বছরের ২৫ নভেম্বর এই চুক্তি করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

প্রকল্পে প্রযুক্তি সরবরাহ ও পরিচালনাকারী কম্পানি হলো ‘সিনেসিস আইটি’। কম্পানিটির সঙ্গে এই কাজে জয়েন্ট ভেঞ্চারে সঙ্গে রয়েছে র‌্যাডিসন টেকনোলজি ও কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক ও স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল আলমের উপস্থিতিতে কমিশনের তরঙ্গ ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল মো. ফয়সল এবং সিনেসিস আইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহরাব আহমেদ চৌধুরী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।

প্রতিষ্ঠানটির এই ভেঞ্চার প্রায় ৩০ কোটি টাকায় এ কাজ করবে। এর মধ্যে ২৩ লাখ ৯ হাজার ৪৬৯ মার্কিন ডলার এবং ১০ কোটি দুই লাখ ৯২ হাজার ৯৫০ টাকা রয়েছে।

কবে নাগাদ বাস্তবায়ন

অবৈধ পথে দেশে আসা ক্লোন বা চুরি করা হ্যান্ডসেটে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০২১ সালের ৯ জুন। প্রযুক্তি সরবরাহ ও পরিচালনাকারী কম্পানি সিনেসিস আইটি তাদের কর্মপরিকল্পনায় এই সময়সীমার কথা জানায়।

চুক্তি স্বাক্ষরের এই দিন থেকেই ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি রেজিস্টার (এনইআইআর) কার্যক্রম চালুর কথা। বিটিআরসি চাইছে এই ১২০ দিন মানে ২০২১ সালের এপ্রিলের মধ্যেই যেন কার্যক্রম চালু হয়ে যায়। তবে কম্পানিটি বলছে, করোনাকালীন বাস্তবতা ও কার্যক্রমের ব্যাপ্তির নিরিখে এটি চালুতে মাস দুয়েক বাড়তি সময় লাগতে পারে।

আরো পড়ুনঃ অবৈধ মুঠোফোন বন্ধ নিয়ে ৬ প্রশ্ন, বিটিআরসির উত্তর

যেভাবে বন্ধ হবে অবৈধ হ্যান্ডসেট

এনইআইআরে এই ডাটাবেজের সঙ্গে মোবাইল অপারেটরে চালু হওয়া মোবাইলের আইএমইআই যাচাই করা হবে, মানে মিলিয়ে দেখা হবে। অপারেটরে চালু হওয়া মোবাইলের আইএমইআই যদি ডাটাবেজের আইএমইআইয়ের সঙ্গে না মেলে তাহলে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। ওই হ্যান্ডসেটে আর সিম সচল হবে না।

যদি হ্যান্ডসেট অবৈধভাবে আমদানি করা হয়ে থাকে এবং যেগুলোর আইএমইআই নম্বর বিটিআরসির তালিকাভুক্ত আমদানিকারক ও প্রস্তুতকারক সংযোজন না করে থাকে সেগুলোর আইএমইআই নম্বর বিটিআরসির ডাটাবেজ হতে পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ আগস্টের আগের হ্যান্ডসেটের আইএমইআই নম্বর এই ডাটাবেজে নেই।

২০১৯ সালের আগস্টের আগে কেনা সিম চালু আছে—এমন কোনো মোবাইল হ্যান্ডসেট বা ফোন বন্ধ হচ্ছে না। আর এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, এই সময়ের পরে কেনা অবৈধ হ্যান্ডসেটের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিদেশ থেকে আনা হ্যান্ডসেটের ক্ষেত্রে কী হবে?

বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হ্যান্ডসেট গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এনইআইআরের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে কেনার রসিদ যাচাই করে এবং যেসব সেট উপহার হিসেবে দেশে এসেছে তা যথেষ্ট প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে বিটিআরসির সিদ্ধান্তে এনইআইআরে সক্রিয় করা হবে।

আরো পড়ুনঃ সত্যি কি দেশে বন্ধ হচ্ছে অবৈধ মোবাইল সেট?

হ্যান্ডসেট নিবন্ধনে গ্রাহকের কী করণীয়?

হ্যান্ডসেট নিবন্ধনে গ্রাহকদের তেমন কিছু করতে হবে না। নিজেদের হ্যান্ডসেটে বায়োমেট্রিক করা নিবন্ধিত সিমটি সক্রিয় করলেই ওই হ্যান্ডসেটটি ওই সিমের পরিচয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধন হয়ে যাবে।

কিভাবে বুঝবেন আপনার ফোনটি আসল না নকল?

হ্যান্ডসেট অবৈধ বা নকল কি না তা দেখেতে বিটিআরসি সঠিক আইএমইআই যাচাই পদ্ধতি রয়েছে। যে কেউ ম্যাসেজে KYD টাইপ করে স্পেস দিয়ে হ্যান্ডসেটের ১৫ ডিজিটের আইএমইআই নম্বর দিয়ে সেটি ১৬০০২ নম্বরে পাঠালে ফিরতি এসএমএসে আইএমইআই নম্বরটি বিটিআরসির ডাটাবেজে সংরক্ষিত রয়েছে কি না তা জানতে পারবেন।

বিটিআরসির ডাটাবেজে আইএমইআই নম্বর থাকলে বুঝতে হবে হ্যান্ডসেটটি বৈধ। আইএমইআই নম্বর নতুন হ্যান্ডসেটের মোড়কেই দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে * # /, . ইত্যাদি বিশেষ চিহ্ন বাদে শুধু ১৫টি নম্বর নিতে হবে বিটিআরসিতে এসএমএসের জন্য।

ব্যবহার করা হ্যান্ডসেটে * # ০ ৬ # ডায়াল করেই জেনে নেওয়া যায় মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত ১৫ ডিজিটের আইএমইআই নম্বর।

লাভ বাড়তি রাজস্ব

বিটিআরসির চেয়ারম্যান মো. জহুরুল হক বলেন, এনইআইআর সিস্টেম চালু হলে সরকার প্রতিবছর চার হাজার কোটি টাকার মতো বাড়তি রাজস্ব পাবে। চুক্তি পাওয়া প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত মোতাবেক যথাসময়ে কাজ শেষ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

Add Comment