ফ্রিল্যান্সিং: জিরো থেকে হিরো হওয়ায় গল্প – পার্ট টু

আমি মোঃ ফরুল ইসলাম তবে অনলাইনে এবং নিজ এলাকায় নেট সাগর নামে পরিচিত। আমি 2011 সালে IITB বগুড়া থেকে ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করি। অতঃপর ঢাকা বেস্কিমকো ডেনিম ডাইং এ জয়েন করি। ওইখানে জব করা অবস্থায় আমার ফ্রিল্যান্সিং শুরু।

অনলাইন ইনকাম সম্পর্কে কিভাবে জানতে পারলেন?

আমি 2010 সালে কম্পিউটার কিনি এবং তখন থেকেই ইন্টারনেট ব্রাউজ শুরু করি। তখন থেকেই টেকটিউনস, প্রথমআলো ব্লগে প্রচুর সময় কাটাতাম। নিজে কিছু লেখার চেষ্টা করতাম এবং নিয়মিত অন্যের ব্লগ পড়তাম। চাকুরীর পাশাপাশি যেখানে থাকতাম ওইখানে এক দোকানে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে কাজ করতাম; যেমন – কম্পিউটারে উইন্ডোজ দেওয়া, কম্পিউটারে সফওয়্যার ইনস্টল, মোবাইলে সফ্টওয়ার দেওয়া ইত্যাদি। চাকুরীর পাশাপাশি এইসব করেও দিনকাল তেমন ভালো যাচ্ছিল না; অতঃপর টেকটিউনসে হেল্প চেয়ে একটা ব্লগ লিখি, “আমাকে আশার আলো দেখে দিন, আমাকে বাঁচার রাস্তা দেখে দিন”। অনেকেই অনেক কমেন্ট করে যে – জব দিবো, আমার সাথে যোগাযোগ করুন ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রিন্স মাহমুদ নামে একজন প্রফেসনাল ব্লগার কমেন্ট করে, “আপনি html, seo, smm ইত্যাদি শিখে ওডেস্ক, ফ্রিল্যান্সার সাইটে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন”।  উনি অনেক বড় ব্লগার তাই উনার কথার উপর আস্থা রেখে আমি ওডেস্কে একটা একাউন্ট করি। তারপর, টেকটিউনসে পোস্ট হওয়া সকল ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত ব্লগ পড়া শুরু করি এবং কিছুদিন পর টেকটিউনস থেকেই সোস্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ইন্টারনেট মার্কেটিং, আর্টিকেল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ওয়াডপ্রেস ইত্যাদি সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করি। অতঃপর ডিজিটাল মার্কেটিং এ ওডেস্কে কাজ করা টপ 20-30 জনের প্রোফাইল দেখে একটা ধারণা নেই যে, কিভাবে প্রফেসনাল প্রোফাইল তৈরি করা যায়; এছাড়াও টেকটিউনসে প্রফেসনাল ওডেস্ক প্রোফাইল তৈরির উপর অনেক ব্লগ পড়েছিলাম। অতঃপর নিজের মতো করে আমার প্রোফাইল সাজাই (কপি পেস্ট ছাড়া)। তারপর জবের এপ্লাই করা শুরু করি; আলহাদুলিল্লাহ! প্রথম সপ্তাহে একটা জব পাই কিন্তু তখন আপফ্রন্ট পেমেন্ট, হায়ার করা এইসবে জ্ঞান কম থাকার কারণে ওই বায়ার অনেক ধোঁকা দেয়। তাই টেকটিউনসে ওডেস্কের বিরুদ্ধে একটা ব্লগ লিখি; মেবি ওই ব্লগ ওডেস্ক বাংলাদেশ এর কোনো কর্মকর্তার নজরে এসেছিল এবং ওডেক্স থেকে আমাকে ওই ব্লগ রিমুভ করতে বলে। আমি সরাসরি বলে দেই, “আগে টাকা পরে ব্লগ ডিলিট করবো”। সেইদিনই ঐ ক্লাইন্ট আমার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাকে $110 কাজের মূল্য পরিশোধ করে। অতঃপর টাকাটা আসে কিনা তা চেক করার জন্য মাত্র $10 ইউএসডি ডাচ বাংলা ব্যাংকে উইথড্র করি. আলহাদুলিল্লাহ! 2-3 দিন পর বুথে কার্ড ঢুকিয়ে দেখলাম আমার জিরো একাউন্ট এ সামথিং সামথিং। তারপর খুশি দেখে কে! বাকি USD গুলো উইথড্র করে দিলাম এবং পুরোদমে ওডেস্ক নিয়ে বসে গেলাম এবং 5-7 টা কাজ শেষ করার পর বুঝলাম আমার আর বেস্কিমকোতে জব করতে হবেনা, অনলাইনে আমার ক্যারিয়ার দাড়িয়ে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই বেস্কিমকো থেকে জব ছেরে বাসায় চলে আসি এবং ফুলটাইম ওডেস্কে কাজ শুরু করি।

কোথায় থেকে ফ্রিল্যান্সিং শিখলেন?

আপনারা হয়তোবা আগের প্যারাতেই বুঝতে পারছেন কোথা থেকে আমি ফ্রিল্যান্সিং শিখেছি। তখন 2G নেটওয়ার্ক ছিল তাই ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে কাজ শেখার সৌভাগ্য ছিলনা। তাই যা শেখার গুগলে সার্চ করে এবং বিভিন্ন ব্লগের ব্লগ টিউটোরিয়াল পরে শিখতাম।

ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়ে কি কি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?

আমি 2G নেটওয়ার্ক থেকে ফ্রিল্যান্সিং করি এবং তখন সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ইন্টারনেট স্পিড; 12-15 কিলোবাইট/সেকেন্ড স্পিডে কাজ করতে হতো। ঘরের মধ্যে ইন্টারনেট পেতোনা তাই কনকনা শীতের মধ্যে অনেক সময় বাহিরে বসে কাজ করতাম। ঘরের মধ্যে জানালার পাশে ল্যাপটপে মডেম লাগিয়ে জানালার পাশে বসে কাজ করতাম। নেটওয়ার্ক পাবার আশায় জানালা খুলে নেটওর্য়াক এর সাথে শীতের দক্ষিনা বাতাস খাইতাম। ঠাণ্ডায় জমে যেতাম কিন্তু তারপরও ভালো লাগতো কারণ প্রতি মিনিটেই টাকা (ঘণ্টা ভিত্তিক কাজ)। কিছুদিন পর মাথায় আসলো যদি মডেমটা বাহিরে রাখি তাহলে তো ঠাণ্ডায় কষ্ট করতে হবেনা। অতঃপর একটা ডাটাক্যাবল কিনে আনি এবং এক পাশে মডেম লাগিয়ে মডেম বাহিরে রেখে অন্যপাশ ল্যাপটপে লাগিয়ে কাজ করি। কিন্তু স্পিড ওই 15-20 কিলোবাইট/সেকেন্ড; এছাড়াও মাঝে মাঝে মডেম ডিসকানেক্ট হয় যাচ্ছিল। তারপর কিছুদিন পর মাথায় এলো এতো দুর থেকে টিভিতে কিভাবে পিকচার আসে, মোবাইলে কিভাবে নেটওয়ার্ক আসে। ঐটা মাথায় রেখে একটা মোবাইল এন্টিনা লাগালাম বাঁশের মাথায় এবং তারের মাথা মডেমের নেটওয়ার্ক আইসির সাথে সংযোগ দেওয়া মাত্র নেট স্পিড 20-25 কিলোবাইট/সেকেন্ড; মানে 2G এর সর্বোচ্চ স্পিড পাওয়া শুরু করলাম। তবে খুশি হবার কিছুনেই কারণ ওইসময় একটা ওয়েবপেজ আসতে 4-5 মিনিট সময় লাগতো। কোনো বায়ার ভিডিওকল দিতে চাইলে বলতাম আমার নেট স্পিড মাত্র 20 কিলোবাইট/ সেকেন্ড; উনারা বলতো, “তুমি কিভাবে এই স্পিডে কাজ করছো?” কিছুই বলতে পারতাম না, চোখে জল আসতো। কিছুদিন পর শুনলাম ধুনট 3G আসছে কিন্তু ধুনট আমার বাসা থেকে প্রায় 12 কিলোমিটার। অতঃপর AliExpress থেকে একটা মোবাইল নেটওয়ার্ক বুস্টার কিনি এবং ঐটা লাগানোর পর আলহামদুলিল্লাহ! রুমের মধ্যে 2 খুঁটি 3G নেটওর্য়াক পেয়ে যাই। আহ্! কি স্পিড! সবুরে মেওয়া ফলে! এটাই তার প্রমাণ।

বর্তমানে কি নিয়ে কাজ করছেন?

আমি মূলত ওডেস্ক, ইল্যান্স এবং ফ্রিল্যান্সার সাইটে একই সময়ে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করতাম। কিন্তু 2014 সালে ভাবলাম নিজের একটা আলাদা ক্যারিয়ার দরকার যেখানে কোনো 3rd পার্টি থাকবে না; আমিই সব। অতঃপর সোস্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর উপর নিজেই একটা ইকমার্স ওয়েবসাইট ডেভেলপ করি। তারপর ওডেস্ক কাজের পাশাপাশি নিজেই SEO করা শুরু করি এবং আলহামদুলিল্লাহ! মাত্র ২ মাস পরই আমার ওয়েবসাইটে ওডেস্কে থেকে আয়ের দ্বিগুণ আয় শুরু হয়। 2012 সালে যেভাবে বেস্কিমকো থেকে জব ছেড়েছিলাম ঠিক ওইভাবেই ওডেস্ক, ইল্যান্স এবং ফ্রিল্যান্সার সাইট থেকে ফ্রিল্যান্সিং করা ছেরে দিলাম। তারপর ফুলটাইম নিজের ওয়েবসাইটের পিছনে সময় দেওয়া শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ! গুগল মামার অবদানে এখনো আমার ওয়েবসাইট ভালই চলছে।

ফ্রিল্যান্সিং এর  ভবিষ্যত কি?

ফ্রিল্যান্সিং এর ভবিষ্যত নিয়ে কি আর বলবো, বিশ্বের কোটি কোটি ফ্রিল্যান্সার তাদের ক্যারিয়ার ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে অনলাইনে দাড় করেছে। আগে তো মানুষ ফ্রিল্যান্সিং বুঝতনা, ফ্রিল্যান্সিং বলতেই ক্লিক বুঝত। ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে আজ সবাই বুঝে; তাই সময় নষ্ট না করে নিজের স্ক্রিল ডেভেলপ করুন। কাজ করতে করতে মার্কেটপ্লেসের একাউন্ট কোনো কারণে সাসপেন্ড হলেও মার্কেটপ্লেস এর বাহিরে আপনি আপনার ক্যারিয়ার দার করাতে পারবেন যদি আপনি দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হন। তাই কাজ শিখুন, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হবেনা।

অনলাইনের বাইরে আর কি কি কাজ করছেন?

অনলাইনে $1 ইনকাম করলে দেশের 83 টাকা হয়; তাই অফলাইনে এপর্যন্ত কিছু চিন্তা করিনি। আল্লাহ যতদিন বেঁচে রেখেছেন, ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সিং ই করবো।

আপনে কি নিজেকে সফল মনে করেন?

সফল হইছি কিনা জানিনা; আমি অনলাইনে কাজ করে নিজের ও পরিবারের অভাব মেটাতে পেরেছি। নিজের সকল চাহিদা মেটাতে পেরেছি; 2015 সালে বাইক এক্সিডেন্ট করে যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি তখনও শুয়ে শুয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে আমার আয় করা অর্থ দিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে আমি সুস্থ হইছি। আমার পরিবার আমার পেশায় খুব খুশি, দিনে যতক্ষণ ইচ্ছা ঘুমাই কেও ডাকেনা। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন, বউ, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু ও গ্রামবাসী সকলে আমাকে নিয়ে গর্ব করে; এটাই আমার বড় পাওয়া।

আপনার ভবিষ্যত প্ল্যান কি?

শহরে 4-5 তলা একটা বাড়ি করার ইচ্ছা যেটা ভাড়া দিয়ে মাসিক টাকা আসবে। ওই লক্ষেই এগুচ্ছি; জানিনা কবে সফল হবো।

নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিং করতে চাচ্ছে তাঁদের উদ্দেশ্য আপনার উপদেশ কি?

এখনতো প্রায় সব জায়গায় 3G/4G নেটওর্য়াক পায় এবং ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত প্রায় সব ক্যাটাগরির কাজের ভিডিও টিউটোরিয়াল ইউটিউব থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় ফ্রি ও পেইড পাওয়া যায়। এছাড়াও গুগলে সার্চ করলে আপনি ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কিত অনেক ব্লগ, ইবুক ও ভিডিও টিউটোরিয়াল পেয়ে যাবেন। ধর্য ধরে কাজ শিখুন, ইনশাআল্লাহ! আপনিও হতে পারেন একজন দক্ষ ফ্রিল্যান্সার।

আমার সাথে যোগাযোগ:

ফেইসবুক প্রোফাইল: https://www.facebook.com/InternetSagor
ফেইসবুক পেজ: https://www.facebook.com/netsagor
টুইটার: https://twitter.com/netsagor
লিংকেডিন: https://www.linkedin.com/in/netsagor/
ওয়েবসাইট 1: https://netsagor.com/
ওয়েবসাইট 2: https://bestsocialplan.com/
ব্লগসাইট: https://bestfreelancehelp.blogspot.com/

Add Comment