আপনি কখনও চিন্তা করেছেন, যে আপনি পথ চেনেন না অথচ কোন লোক ছাড়া আপনি নিজেই গন্তব্য স্থলে জেতে পারবেন? এও কি সম্ভব. হা আজকের এই প্রজুক্তির জুগে এটাও সম্ভব। আর এটা সম্ভব হোয়েছে জিপিএস এর মাধমে। আপনাকে সাহায্য করার জন্য আছে অনলাইন ম্যাপিং সার্ভিস। চারদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দূরত্ব, ট্রাফিক জ্যাম এর অবস্থা পর্যন্ত বলে দিচ্ছে গুগল ম্যাপস।
গুগল ছাড়াও হিয়ার, অ্যাপল ম্যাপস, উই গো কিংবা মাইক্রোসফট বিং ম্যাপ এর মতো সার্ভিসগুলো ম্যাপিং সেবা দিলেও আমাদের আশেপাশে গুগল ম্যাপস ব্যবহারকারীই বেশি। তাই উদাহরণ হিসেবে গুগল ম্যাপের কথাই বলা হলো।
অ্যাপল ম্যাপস, গুগল ম্যাপস কিংবা অন্যান্য ম্যাপিং সার্ভিস অথবা হালের পাঠাও কিংবা উবার, এদের সাফল্য বলেন কিংবা আপনার সুবিধা- যা ই বলেন না কেন; সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে একটা যাদুকরী প্রযুক্তি। আর সেটা হলো গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা সংক্ষেপে জিপিএস (GPS), যা না থাকলে আপনি হয়তো গুগল ম্যাপ পেতেন- কিন্তু আপনি ঠিক কোন স্থানে আছেন তা জানতে পারতেন না। কিংবা পাঠাও/উবার থাকলেও চালক হয়তো আপনাকে খুঁজে পেতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগিয়ে দিতেন।
অনেকের কাছে “গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম” কথাটা অপরিচিত লাগলেও “জিপিএস” বলার পর আর কারো কাছে অপরিচিত লাগছে না আশা করি। কিছু কিছু ফোনে একে “লোকেশন” নামেও লেখা থাকে। আর নতুন পাঠ্যক্রমের কল্যাণে আজকাল মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদেরও জিপিএস কী এটা নিয়ে ধারণা থাকার কথা।
কিন্তু জিপিএস কীভাবে কাজ করে সেটা হয়ত কম মানুষই জানেন। তবে কৌতূহল যে অনেকেরই আছে তা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে জিপিএস কিভাবে কাজ করে? আপনার সেই কৌতূহল মেটানোই এই টিউনের উদ্দেশ্য।
জিপিএস কী? What is GPS
নামকরণের সার্থকতা বিচার করেন আর না ই বা করেন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস (GPS) আসলেই একটা চমৎকার সিস্টেম। আরো স্পষ্ট করে বললে এটা হলো পৃথিবীর কক্ষপথে রাখা কমপক্ষে ২৪ টি কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের সাহায্যে তৈরি একটি সিস্টেম। অবশ্য সাথে ব্যাকআপ হিসেবে আরো ৩টি স্যাটেলাইট রাখা আছে– দূর মহাশূন্যে কখন কী হয় বলা তো যায় না! অবশ্য, কোনো কোনো হিসেব মতে জিপিএসে মোট ৩২টি স্যাটেলাইট আছে।
জিপিএসের এই কৃত্রিম উপগ্রহগুলো কিন্তু একসাথে অবস্থান করছে না। বরং পৃথিবীর চারপাশে প্রায় সমান দূরত্বে (প্রায় ১২০০০ মাইল উচ্চতায়) এগুলো এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন সবগুলো স্যাটেলাইট মিলে পুরো পৃথিবীর প্রত্যেকটা অংশ (এমনকি অ্যামাজন বনের কোন গহিন অংশও) সিগন্যাল পাঠিয়ে কাভার করে। অন্তত ৪টি স্যাটেলাইট আপনি আপনার “সাথে” পাবেনই, এমনটি মাথায় রেখেই এই পুরো নেটওয়ার্ক সাজানো হয়েছে।
জিপিএস কীভাবে কাজ করে? How to use GPS
আপনার ফোনে যে জিপিএস চিপটি আছে সেটা হচ্ছে জিপিএস সিগন্যাল রিসিভার। এটা জিপিএস স্যাটেলাইট থেকে আগত সিগন্যাল ধরতে পারে। এই রিসিভার চিপ কোনো তথ্য ট্রান্সমিট করে না বা স্যাটেলাইটের নিকট প্রেরণ করেনা।
শুরুতে যে ২৪টি স্যাটেলাইটের কথা বলেছিলাম, ঐ স্যাটেলাইটগুলো আসলে দিনে ২৪ ঘন্টা আর সপ্তাহের সাত দিনই এক ধরনের রেডিও সিগন্যাল ট্রান্সমিট করতে থাকে। সেই সিগন্যাল ধরার ক্ষমতা জিপিএস চিপ এর মাঝে আছে যা আপনার স্মার্টফোন কিংবা কার ট্র্যাকারে থাকে। আজকাল অবশ্য জিপিএস চিপ স্মার্টওয়াচ এমনকি চাবির রিংয়েও থাকে।
জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোতে এটমিক ক্লক লাগানো থাকে যা দিনের পর দিন ধরে খুবই সূক্ষ্ম সময় দেয়। আর আপনার ফোনে তো একটা ঘড়ি আছেই। স্যাটেলাইটগুলো যে সিগন্যাল পাঠায় তাতে মূলত সিগন্যালটি সেন্ড করার সময়কার সময় থাকে। আপনার ফোনটি প্রাপ্ত সিগন্যালটির উৎপন্ন হওয়ার সময় আর আপনার ফোনটি যখন সেই সিগন্যালটি রিসিভ করেছে তার ব্যবধান থেকে ঐ স্যাটেলাইট আর আপনার ফোনের মধ্যকার প্রকৃত দূরত্ব হিসেব করে ফেলে। এই দূরত্ব থেকেই মূলত জিপিএস আপনার অবস্থান নির্ধারন করে।
কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো, আপনি একটা জিনিসের সাথে আরেকটা জিনিসের দূরত্ব দিয়ে দ্বিতীয় জিনিসের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবেন না। সেখানে অবস্থান নির্ণয় করতে হলে আপনাকে কমপক্ষে তিনটি জিনিসের সাপেক্ষে দূরত্ব নিতে হবে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি ক্লিয়ার হবে। ধরা যাক, আপনার বন্ধু আপনাকে ফোনে জানালো যে সে জাতীয় সংসদ ভবন এর গেইট থেকে সরাসরি ১ কিলোমিটার দূরে আছে (বা কিছু বেশি)। শুধুমাত্র এতটুকু শুনলে আপনি কিন্তু কোনো ভাবেই জানবেন না সে আসলে কোথায় আছে। কারণ সে সংসদ ভবন থেকে যে কোনো দিকে ১ কিলোমিটার দূরে থাকতে পারে। তার মানে, সংসদ ভবনের চারপাশে যদি ১ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটি বৃত্ত কল্পনা করা হয় তাহলে সে বৃত্তের পরিধি বরাবর যে কোনো জায়গায় থাকতে পারে।
এবার যদি সে বলে যে সে একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও দেড় কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে তাহলে কি হবে? তাহলে আপনার কাছে তার অবস্থান আরেকটু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এবার আপনি যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কেন্দ্র করে ১.৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত কল্পনা করেন তাহলে দেখবেন যে এই বৃত্তটি আগের বৃত্তটিকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করেছে। তার মানে আপনার বন্ধু এই দুই বিন্দুর কোন একটিতে আছে। তাও কিন্তু আপনি আপনার বন্ধুর লোকেশন পেলেন না।
এবার যদি আপনার বন্ধু আপনাকে বলে যে সে তেজগাঁও রেল স্টেশন থেকেও সোজাসুজি ৫০০ মিটার দূরত্বে আছে তাহলে? তাহলে আপনার কাজ হয়েই গেলো। এবার তেজগাঁও রেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে ৫০০ মিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত কল্পনা করলে দেখবেন যে তিনটি বৃত্তই একটি মাত্র সাধারণ বিন্দুতে ছেদ করেছে। আর সেই ছেদবিন্দুটি হলো ফার্মগেট বাস স্টপ। আর আপনার বন্ধু আসলে ফার্মগেট বাস স্টপেই আছে। মজার না ব্যাপারটা? এই হিসেবটিকে বলা হয় ট্রাইল্যাটেরেশন।
জিপিএসও এই নীতিতেই কাজ করে। আপনার ফোনের জিপিএস চিপটি একই সাথে ৩-৪টি জিপিএস স্যাটেলাইট থেকে নিজের দূরত্ব নির্ণয় করে নেয়। সাধারণত তিনটি জিপিএস স্যাটেলাইটের সিগন্যাল নিয়েই উপরের উদাহরণের মতো আপনার লোকেশন বের করে ফেলে আপনার ফোনটি। এভাবে যত বেশি স্যাটেলাইটের সিগনাল পাবে আপনার লোকেশনও তত বেশি এক্যুরেট পাবেন। খোলা আকাশের নিচে এই সিস্টেম সবচেয়ে ভালো কাজ করে, কারণ স্যাটেলাইট সিগন্যাল পেতে তখন সুবিধা হয়।